জোয়ান অব আর্ক: যে বীরনারীকে খ্রিস্টান যাজকগণ আগুনে পুড়ে মেরেছিল

Oct 31, 2024 - 17:10
Oct 31, 2024 - 20:56
 1  14
জোয়ান অব আর্ক: যে বীরনারীকে খ্রিস্টান যাজকগণ আগুনে পুড়ে মেরেছিল
মুবাশশিরা মৌরি, রোল: ২. শাখা :ড্যাফোডিল শ্রেণী: অষ্টম

ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডয়ার্ড ফ্রান্সের সিংহাসন দাবী করলে দুই দেশের মধ্যে শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। ফ্রান্সের রাজারা বহুভাগে বিভক্ত হযে পড়েন। রাজা সপ্তম চার্লস পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে ইংরেজদের ফ্রান্স থেকে বিতাড়নের চেষ্টা করেন। হারানো স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রকাশ করেন জোয়ান অব আর্ক নামের এক কিশোরী-যুবতী। ইংরেজ সমর্থিত ফরাসিদের হাতে ধরা পড়ে ধর্মযাজকদের বিচারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় । আমরা আজ এই মহিয়ষী নারীর গল্পই শুনব।

উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের মিউজ নদীর তীরবর্তী দমরেমি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে ১৪১২ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জোয়ান অব আর্ক। তার পিতার নাম ছিল জ্যাক্স দ্য’আর্ক ও মায়ের নাম ইসাবেল রোমি। তৎকালের আর দশজন কৃষক কন্যার মতোই ঘরকন্না আর ভেড়া চড়ানোর বাইরে জোয়ানও কোন বিদ্যালয়ে গিয়ে লিখতে শিখেননি।

১৩ বছর বয়সে জোয়ানের ভিতর বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ঈশ্বর তাকে ইংরেজদের কাছ থেকে ফ্রান্সের স্বাধীনতা অর্জনের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তিনি আজীবন সতী কুমারী থাকার শপথ গ্রহণ করেন। ১৬ বছর বয়সে তাকে বিবাহ দেয়ার চেষ্টা হলে তিনি স্থানীয় আদালতের মাধ্যমে তা প্রতিহত করেছিলেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে উন্মুখ ১৪২৮ মালের মে মাসে জোয়ান ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত দুর্গ কমান্ডার রবার্ট দ্য বাউড্রিকোর্ট এর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন যে তিনি ফ্রান্সকে শত্রুমুক্ত করতে যিশুর আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাই তাকে যে কোনভাবেই হোক রাজা সপ্তম চার্লসের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতেই হবে। অনিচ্ছা সত্বেও বাউড্রিকোর্ট জোয়ানকে কয়েকজন সৈন্যসহ রাজা চার্লসের নিকট পাঠান।

জোয়ানের বারংবার অনুরোধে ১৪২৯ সালে গ্যারিসন কমান্ডার বাউড্রিকোর্ট জোয়ানকে একটি ঘোড়াসহ কয়েকজন সৈন্য দেন। জোয়ান তার চুল ছেঁটে ছেলেদের পোশাক পরে অতি সঙ্গোপনে শত্রু এলাকার মধ্য দিয়ে  এগার দিন ভ্রমণ করে নির্বাসিত রাজা চার্লসের দরবারে হাজির হন।

রাজা চার্লসের দরবারে জোয়ান সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে রাজা প্রথমে তাকে সাক্ষাৎ দিতেই অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে সাক্ষাৎ দেন। কিন্তু সব কিছু শুনে তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন। চৌদ্দ বছরের এক অশিক্ষিতা গ্রাম্য বালিকা কোন প্রকার সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই পুরুষ সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়ে পরাক্রমশালী ইংরেজদের পরাজিত করবে। তাও কি সম্ভব? তিনি আশঙ্কা করলেন এই নারী ছলনাময়ী কেউ হতে পারে। তাই তিনি দরবারের ধর্মগুরুদের ডেকে জোয়ানকে ভাল করে পরীক্ষা করতে বললেন। ধর্মযাজকগণ জোয়ানকে পরীক্ষা করে রাজাকে রিপোর্ট দিলেন যে জোয়ান অব আর্ক আসলে একজন ঐশ্বরিক আশীর্বাদ প্রাপ্ত বালিকা। তিনি সতী, ধর্মভীরু এ দেশপ্রেমিক।

রাজা শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। তিনি ১৭ বছরে যুবতী জোয়ানকে বর্ম ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রসহ অর্লিন্স দখলের জন্য একটি ছোট সৈন্যবাহিনী প্রদান করলেন। ১৪২৯ সালের ৪-৭ মে পর্যন্ত বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে বিজয়ী হয়ে ফরাসি সৈন্যগণ অর্লিন্সের ইংরেজ ঘাঁটি দখল করে নিলেন। যুদ্ধে জোয়ান আহত হয়ে বেশি কিছুদিন চিকিৎসাধীন থেকে পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করেন। জুনের মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি সৈন্যগণ ইংরেজদের মোটামুটি বিধ্বস্ত করে দেয় যেখানে জোয়ানের কৃতিত্বই ছিল উল্লেখযোগ্য 

অর্লিন্সে ইংরেজগণ পুরোপুরি পরাজিত হলে জোয়ান ইংরেজদের পরবর্তী ঘাটি রেইমস আক্রমণের অনুমতির প্রার্থনা করেন। কিন্তু জোয়ানের নেতৃত্বে বিশ্বাস থাকলেও রাজা ধীর গতিতে অগ্রসর হতে চাইলেন। অবশেষে ১৮ জুন জোয়ানের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী রেইমস দখল করে চার্লসকে আনুষ্ঠানিকভাবে সপ্তম চার্লসরূপে ফরাসি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে। রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে কৃতজ্ঞ রাজা চার্লস জোয়ানকে তার কাছেই স্থান দেন।

 রাজা সপ্ত চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তার ফ্রান্স তখনও সম্পূর্ণরূপে শত্রু মুক্ত হয়নি। বার্গান্ডিবাসীদের সহায়তায় ইংরেজগণ তখনও উত্তরফ্রান্স দখল করে ছিল। তাই ১৪৩০ সালের বসন্তকালে রাজা জোয়ানের নেতৃত্বে আর একটি সৈন্যবাহিনী বার্গান্ডির দিকে প্রেরণ করেন। বার্গ্যান্ডদের সাথে যুদ্ধে জোয়ান ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বন্দী হন। বন্দী জোয়ান ইংরেজদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিকার ছিল। তাই তারা যেকোন মূল্যে জোয়ান গ্রেফতার পূর্বক হত্যা করতে চাইছিল। প্রায় কয়েকমাস ধরে বার্গ্যান্ডগণ ইংরেজদের সাথে দরকষাকষি করে দশ হাজার ফরাসি মুদ্রার বিনিময়ে বীরনারী জোয়ান অব আর্ককে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়।

জোয়ানের বিচারের সময় একটি বিষয় বিতর্কের সৃষ্টি করে ছিল যে তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন না ঈশ্বর তথা ধর্মের বিরুদ্ধে। তিনি যেহেতু রাজা সপ্তম চার্লসের সপক্ষে ছিলেন, তাই  ইংরেজ সমর্থিত বার্গান্ডির ফরাসি শাসকগণ তাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপকদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত তাকে ধর্মদ্বেষীরূপেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

বন্দী অবস্থা থেকে জোয়ান কমপক্ষে দুবার পলায়নের চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় চেষ্টায় তিনি দুর্গের টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে আহত হন। তার বিচারকালে এই পলায়ন চেষ্টাকে আত্মহত্যার চেষ্টা হিসেবে গণ্য করে ৭২টি অভিযোগের একটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

দুই দিন  পর বিচারগণ জোয়ানকে কয়েদখানায় দেখতে যান। সেখানে তারা তাকে পুরুষের পোশাক পরা অবস্থায় দেখতে পান। জোয়ান এর কারণ হিসেবে বলেন, আলেকজান্দ্রিয়ার সেইন্ট ক্যাথারিন ও অ্যান্টিওকের সেইন্ট মার্গারেট স্বীকারোক্তি দিয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

যাজকদের চাপে পড়ে এক সময় জোয়ান একটি স্বীকারোক্তিপত্রে সই করেন। তবে নিরক্ষর জোয়ান জানতেনও না সেখানে কি লেখা রয়েছে। তবে তার পাপ স্বীকারের বিনিময়ে তাকে আজীবন বন্দী থাকার সাজা দেয়া হয়েছিল। হাজত খানায় কিছু দিন তিনি যাজকদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি মতে পুরুষের পোশাক ছেড়ে নারীদের পোশাকও পরেছিলেন। কিন্তু এর মাঝে তার মনে পুনরায় পূর্বের জেদ জেঁকে বসে। অনেকের মতে তাকে হাজত খানার গার্ডরা ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল। 

 ঘটনা যাই হোক তিনি পুনরায় পুরুষের পোশাক পরা শুরু করেন। যাজকগণ হাজতখানা পরিদর্শনে গেলে তিনি বলেন, তাকে আলেকজান্দ্রিয়ার সেইন্ট ক্যাথারিনসহ অন্যান্যরা পুনরায় এ আদেশ দিয়েছেন বলেই পূর্বের  মতো পোশাক পরছেন। এবার যাজকগণ আর সহ্য করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তাকে পুরুষের পোশাক পরার অপরাধেই জীবন্ত দগ্ধ করার সাজা দেয়া হয়। ১৪৩১ সালের ২৯ মে তাকে রুয়েন শহরের একটি বাজার এলাকায় নিয়ে গিয়ে প্রায় দশ হাজার উৎসুক জনতার সামনে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়। 

জোয়ানের মৃত্যুর বিশ বছর পরে ১৪৫০ সালে রাজা সপ্তম চার্লস জোয়ানের মৃত্যুদণ্ডস্থান রুয়েনের প্রবেশ করেই এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের আদেশ দেন। তদন্তে তাকে নির্দোষরূপে চিহ্নিত করা হয়।  আর্কের পরিবার এই প্রহসনের বিচারকে বাতিল করে পুনরায় বিচার করার জন্য পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাসের কাছে আবেদন করেন। পুনর্বিচারে পোপ পূর্বের আদেশ বাতিল করে জোয়ানকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। পাঁচশত বছর পর পোপ পঞ্চম বেনেডিক্ট জোয়ানকে খ্রিস্টান সেইন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯২০ সালে ফরাসি পার্লামেন্ট প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় শনিবারকে জোয়ানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় উৎসব দিবস ঘোষণা করে।

 

রচনা সূত্র:

১. https://www.britannica.com/biography/Saint-Joan-of-Arc/Character-and-importance

২.https://www.history.com/topics/middle-ages/saint-joan-of-arc

৩.https://www.biography.com/military-figures/joan-of-arc

৪.https://www.history.com/news/7-surprising-facts-about-joan-of-arc


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।