ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের নিয়োগ: কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনের উত্তম প্রয়োগ

আধুনিক পুলিশিং এর একটি অপরিহার্য দর্শন হল, কমিউনিটি পুলিশিং। এ দর্শনানুসারে অপরাধ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি সমগ্র কমিউনিটির সম্মিলিত প্রয়াস। এখানে পুলিশ কমিউনিটি তথা সমাজের সহায়তাকারী মাত্র। মানুষ যেমন নিজ উদ্যোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পারে কিংবা করতে হয়, তেমনি তারা নিজ উদ্যোগে নিজেদের নিরাপত্তা ও অপরাধ প্রতিরোধও করে। মানুষের শরীর সুস্থ রাখতে যেমন, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাক্তারের পরামর্শ ও সহায়তা গ্রহণ করতে হয়, তেমনি সামাজের শরীর সুস্থ রাখতে পুলিশের সহায়তা নেওয়াও জরুরী হয়ে পড়ে।
সমাজের সদস্য ও পুলিশ সংগঠন উভয়কেই এই নীতির উপর ভিত্তি করে যৌথ উদ্যোগ ও অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সমাজের অপরাধ প্রতিরোধ ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। আধুনিক সমাজে সাধারণ মানুষ অপরাধ নিবারণে ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতার একটি চূড়ান্ত সীমা রয়েছে, যে পর্যন্ত গেলে তাদের সরকারি সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। পুলিশই হল সেই সংস্থা যারা দিবারাত্র জনগণের সেবা প্রদানে নিয়োজিত থেকে জনগণকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়।
জনগণ চাইলে আইনের ভিতর থেকে অনেক কাজই পুলিশ ও কমিউনিটি উভয়েরই কল্যাণ সম্পাদন করা যেতে পারে। পুলিশ অপরাধ প্রতিরোধ বিষয়ে জনগণের সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারে, তেমনি জনগণও পুলিশের জনবল ও অর্থবলের ঘাটতিও নির্ধারিত আইনি কাঠামোর মধ্যেই দূর করতে পারে। পুলিশ যেমন সরকারি ক্ষমতা, যানবাহন ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে সহায়তা করতে পারে, তেমনি জনগণও পুলিশকে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে একই কাজ করতে পারে। পুলিশের সকল কাজে জনগণের সরাসরি অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠান সুযোগ না থাকলেও সাধারণ কিছু কাজে, যেমন, রাত্রিবেলা পাহারা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজে সরাসরি সহযোগিতা করতে পারে।
সম্প্রতি জুলাই/২৪এর বিপ্লবের পর পুলিশ বিভাগের বিধ্বস্ত অবস্থায়, ছাত্র-ছাত্রীগণ স্বেচ্ছায় পুলিশের দায়িত্ব, বিশেষ করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিল। যে কয়দিন পুলিশকে ঢাকা শহরে সক্রিয় করা সম্ভব হয়নি, সে কয়দিন ট্রাফিক শৃঙ্খলার জন্য জনগণ ছাত্রছাত্রীদের উপরই নির্ভর করতে হয়েছিল। কিন্তু এর দুই মাসেরও বেশি সময়ে রাজধানী শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি শৃঙ্খলায় না আসার প্রেক্ষিতে শুরু হওয়া ট্রাফিক সপ্তাহে মাননীয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশের সাথে স্বেচ্ছা ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের নিযুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি তিনি তাদের দৈনিক কিছু সম্মানী দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে নেট দুনিয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলার কাজে অভিজ্ঞতা ও অপরাধ প্রতিরোধে তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ যদিও পুলিশের কোর ফাংশনগুলোর মধ্যে পড়ে না, তথাপিও পুলিশ ভিন্ন অন্যদের উপর এ দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া দেশের অর্থনৈতিক ও শৃঙখলাজনিত দিক দিয়েও কল্যাণকর নয়। নিউজিল্যান্ড ১৯৩০ সালে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নন-পুলিশ বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল ও অপরাধ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ কাজে দ্বৈততা পরিহার করতে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে তা পুলিশের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
কিন্তু সমস্যা হল, পৃথিবীর যেকোনো দেশেই প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা অনেক কম থাকে। আর শ্রমঘন ও একঘেঁয়েমিপূর্ণ হওয়ায় একাজে সংশ্লিষ্টরা অতি সহজেই বিরক্ত হয়ে পড়ে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকলে দ্রুত বিশৃঙখলার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায়, পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করানো হয়। ব্রিটেনে কমিউনিটি সাপোর্ট অফিসার নামের এক শ্রেণি স্বেচ্ছাসেবক পুলিশিংকে খণ্ডকালীন পেশা হিসেবেও গ্রহণ করে।
ইউরোপ, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের পুলিশেদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য পুলিশ ক্যাডেট, কমিউনিটি সাপোর্ট অফিসার, পুলিশ জুনিয়র কল, ফেন্ডস অব পুলিশ ইত্যদি নামে ছাত্র ও যুব সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠন পরিচালনার জন্য পুলিশ বাজেট থেকে সরকার অর্থ খরচও করে। সিংগাপুরের ন্যাশনাল সার্ভিসের অধীন প্রত্যেক নাগরিককে প্রতি মাসে কয়েকদিন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবহিনীতে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে হয়। ফলে এসব সংগঠনের জনবল ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হয়।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতে পুলিশের সাথে অংশীদারিত্ব ও স্বেচ্ছা সেবার ভিত্তিতে কাজ করার গুরুত্ব বহুলাংশে বৃ্দ্ধি পেয়েছে। তবে মনে রাখা দরকার, স্বেচ্ছাসেবা মানে সম্পূর্ণরূপে ‘ঘরে খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ নয়। পুলিশের সাথে কাজ করা কোনো ব্যক্তির নিয়মিত চাকরির অংশ নয়। কিন্তু এখানে তাদের আপ্যায়ন, আসা-যাওয়ার খরচ ও ঝুঁকির জন্য সরকারকে অবশ্যই কিছু অর্থ ব্যয় করতে হবে।
বাংলাদেশেও বিষয়টি পূর্ণ বিবেচনার দাবী রাখে। এ কাজে প্রয়োজনীয় খরচের জন্য সরকার একটি আলাদা কোডে পুলিশকে বাজেট বরাদ্দ দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক চাত্র-ছাত্রী এ স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে কিছুটা আর্থিকভাবে লাভবানও হতে পারে। এর ফলে সরকারও নিয়মিত নিয়োগের বাইরে পুলিশের লোকবলের ঘাটতি সাময়িকভাবে পূরণ করতে পারে।