তরুণদের প্রতি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ার অনুরোধ
বাঙালি ও বাংলাদেশে বাসবাসকারী সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হচ্ছে আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। কেবল আমরা কেন, কোন জাতিরই স্বাধীনতা যুদ্ধকে তাদের অন্য কোন সাফল্য দিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় জীবনে আরও অনেক বড় বড় ঘটনা রয়েছে যাদের মধ্যে ২৪ এর গণঅভ্যূত্থান অনেক বেশি বেদনায়দায়ক আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকবে। কিন্তু একাত্তরকে অতিক্রম করার মতো অন্য কোন ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে হয়তো আসবে না। আমরা তা হতে দিতেও পারি না।
আমার নিজের বয়সের সমান বয়সীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব স্মৃতি ধারণের সুযোগ পায়নি। কিন্তু আমাদের পূর্ব পুরুষদের আত্মত্যাগের ইতিহাস এখনও সমুজ্জ্বল এবং তা চিরকালই সমুজ্জ্বল থাকবে। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতাকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের ইতিহাস পড়তে হবে। যে জাতির তরুণ যুবকরা ইতিহাস পাঠে বিমুখ তারা দেশপ্রেমের সংকটে ভোগে। দেশ প্রেমের সঙ্কট থেকে শুরু হয় নানাবিধ প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতা।
ইতিহাসের জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য তরুণ প্রজন্ম আমাদের জাতীয় নেতাদের ভুল বোঝেন। শত বছর পূর্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে তারা বর্তমানের সাথে এক করে দেখেন। ফলে জাতীয় নেতাদের প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের তাচ্ছিল্যের ভাব তৈরি হয়। তারা মনে করে, আজকের সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবেশে বসবাস করে তারা যেমন স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে, আমাদের পূর্ব পুরুষরাও নিশ্চয়ই তেমনি পরিবেশেই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
তারা এটা করতে পারতেন, ওটা করতে পারতেন। এটা করা তাদের জন্য সঠিক হত। কিন্তু তা না করে তারা বেঠিক পথ বেছে নিয়েছিলেন। এটা করলে আমরা দ্রুত স্বাধীন হতে পারতাম। কিংবা ওটা করলে আমাদের স্বাধীনতার সাফল্যে অন্য কেউ ভাগ বসাতে পারত না।
কিন্তু ইতিহাস পড়লে এ সব কিছুরই সহজ সমাধান হতে পারে। ইতিহাস পাঠে নিজেকে ১৯৭১ এর পটভূমিতে স্থাপন করে, সেই সময়ের ইতিহাস গড়ার কারিগরদের পাশাপাশি নিজেদের চিন্তা করে আমাদের মহান নেতা ও অগণিত শহীদদের প্রতি আরও বেশি আবেগাল্পুত হওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন ও যৌবন উৎসর্গকারীদের আরও এক মাত্রা বেশি ভাল বাসা যায়। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক ইতিহাস পড়ার জন্য আমি সবার প্রতি আহবান জানাই।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস তো বিকৃত করা হয়েছে। যে দল যখন ক্ষমতায় গিয়েছে, তারা তাদের নিজেদের মতো করে ইতিহাস লিখেছে। কেউ একজনকে স্বাধীনতার সকল কৃতীত্ব দিয়ে অন্যদের কৃতীত্বহীন বলে আস্ফালন করেছে। ক্ষমতার পালাবদলে কেবল ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু কৃতীত্বের দখলদারিত্বের মাত্রা একই রকম রয়েছে। তাই ইতিহাস পড়ে বিভ্রান্তি বাড়াব কেন? এর পরিবর্তে ইতিহাসের জ্ঞানহীন নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটানোই উত্তম নয়কি?
অস্বীকার রার উপায় নেই যে, ইতিহাসকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অনুকুলে লিপিবদ্ধ করা মানুষের মজ্জাগত। কিন্তু সেই আনুকুল্য তো ক্ষমতার বাইরে গেলে আর থাকে না। তাই ক্ষমতার বলয়ের বাইরেও হাজার হাজার ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের ইতিহাসগ্রন্থ রয়েছে। এসব গ্রন্থ ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত। বাজারে শত শত প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধার লিখিত স্মৃতিকথা ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ রয়েছে। একই ঘটনার উপর একাধিক মুক্তিযোদ্ধারও লেখনি রয়েছে। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের কুশীলবদের রাষ্ট্রীয় সীমানাও এক নয়। বাংলাদেশ, ভারত এমনকি পাকিস্তানের লেখকদের বই পুস্তকও এখন বাজারে আমাদের মাতৃভাষায় পাওয়া যায়। তাই কেবল একজনের বা এক পক্ষের নয়, বহুপক্ষের বর্ণনাও আমাদের কাছে সহজলভ্য হয়েছে।
আমাদের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ বর্তমানে সোসাল মিডিয়ায় আসক্ত। কিন্তু এই আসক্তির ভাল দিকও রয়েছে। সোসাল মিডিয়া আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারে। সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক দুর্লভ বই পুস্তকের বর্ণনা এমনকি সেগুলোর পিডিএফ কপি সংগ্রহ করা যাচেছ। আমাদের তরুণদের সদিচ্ছা থাকলে তারা সোসাল মিডিয়া থেকেও ইতিহাস জানতে পারে ও মুল বইগুলোও পড়তে পারে।
এক সময় ব্যক্তিগতভাবে ক্রয় করে কিংবা গ্রন্থাগার থেকে ধার করে বই পড়তে হত। কিন্তু এখন তো সব কিছুই আমাদের হাতের মুঠোয়। তাই আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় জ্ঞানার্জন সম্ভব। তরুণরা, তোমরা ইতিহাস পড়। ইঁট, কাঠ, বালি, পাথর আর কংক্রিটের উন্নয়ন তোমাদের হয়তো বস্তুগত সুবিধা দিবে। কিন্তু বই দিবে তোমাদের মনের উন্নয়ন। সোসাল মিডিয়ায় গুজবের কবল থেকে তোমাদের রক্ষা করবে, বই পড়া, ইতিহাস পড়া, সাহিত্য এমন কি বিজ্ঞানের বই পড়লেও গুজবকে সত্য বলে ভ্রম হবে না। বর্তমানের সামাজিক অস্থিরতা উপসমের অন্যতম উপায় হচ্ছে বই পড়া।