নুবিয়ান সম্রাজ্ঞী আমানিরেনাস যার সাথে অগাস্টাস সিজারও সন্ধি করেছিল

Dec 13, 2024 - 15:48
Dec 28, 2024 - 14:51
 0  22
নুবিয়ান সম্রাজ্ঞী আমানিরেনাস যার সাথে অগাস্টাস সিজারও সন্ধি করেছিল
ছবি এডিটঃ সম্পা রানী সরকার

 আফ্রিকান সভ্যতা বলতে সাধারণভাবে আমরা মিশরীয় সভ্যতাকেই বুঝি। এখানে প্রাচীনকালে ফেরাউনগণ, পরে মধ্যপ্রাচ্যের আক্কাদীয়গণ, তারপর রোমানগণ এবং সবশেষ সুমলিমগণ শাসন করেছিল। কিন্তু মিশরীয় সভ্যতার বাইরেও আফ্রিকায় মিশরীয় সভ্যতার সমান শক্তিশালী আরও অনেক সভ্যতাই ছিল। বর্তমানের মিশরের দক্ষিণাঞ্চল, সুদান ও দক্ষিণ সুদানের কিছু অংশ নিয়ে এমনি একটি সভ্যতা ছিল যাকে বলা হয় ‘নুবিয়ান সভ্যতা’।

 নুবিয়ান সভ্যতার অনেক রাজবংশ ছিল যাদের প্রধানতম ছিল কুশাইট বংশ্ খ্রিস্টপূর্ব ১০৭০ অব্দ থেকে শুরু করে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মুসলিম বিজয় পর্যন্ত টিকেছিল। নুবিয়ানদের সাথে পেরে না ওঠে ফারাও,  আক্কাদিয়ান, টলেমি এবং সর্বশেষ রোমানগণও কুশাইট সাম্রাজ্যের সাথে সহঅবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছিল।

 কুশাইট সাম্রাজ্যে নারীদের রাজ্য শাসন ছিল অতি সাধারণ বিষয় । পৃথিবীর অন্যান্য সাম্রাজ্যে যখন নারীদের শাসন কল্পনা করা যেত না তখনও এই বংশে কমপক্ষে তিনজন নারী সম্রাজ্ঞীর আবির্ভাব ঘটেছিল। আমাদের আজকের গল্প নুবিয়ানদের শেষ সম্রাজ্ঞী রানী আমানিরেনাসকে নিয়ে। কুশাইট রাজবংশের এই রানী যখন নুবিয়া শাসন করছিল তখন মিশরের টলেমি বংশের সম্রাজ্ঞী ছিল ক্লিওপেট্রা।

 কুশাইট রাজ্যের এই নারী শাসক ইতিহাসে প্রশিদ্ধ হয়ে আছেন রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারেরর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার কৃতীত্বের জন্য। তার সমসাময়িক রানী ক্লিওপেট্রা যখন রোমনদের সাথে সমঝোতা করে মিশরকে রোমানদের করদ রাজ্যরূপে টিকে থাকার চেষ্টারত, সেসময় কুশাইট রানী আমানিরেনাস রোমানদের বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে লডেছিলেন।

 রানী আমানিরেনানের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৫৭ অব্দে  কুশাইট রাজ্যের মেরোইটিক রাজবংশে। এই বংশে আখানি শাখেতে ও শানাকডাখেতে নামে আরও দুজন নারী শাসকের ইতিহাস রয়েছে। এসব রানীও পুরুষদের মতোই নেতৃত্বদানে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু রানী আমানিরেনাসের মতো তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করতে হয়নি। রানী আমানিরেনাসের রাজ্যশাসনের হাতেখড়ি তার স্বামী রাজা তেরিতেকাসের রাজত্ব কালেই। তবে খ্রিস্টপূর্ব ২৫ অব্দে তার স্বামী মারা গেলে তিনি পরিপূর্ণরূপে রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। এসময় তার একমাত্র সন্তান আকিনিড নাবালক ছিলেন।

 শাসনভার গ্রহণ করেই রানী আমানিরেনাস ক্রমবর্ধমান রোমান সাম্রাজের আগ্রাসনের মুখে পড়েন। রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের সাথে  রাজনীতির খেলায় পরাজিত হয়ে অ্যান্টনি ও তার প্রেমিকা ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করলে মিশর রোম সাম্রাজ্যের এইট অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যের কুশাইট রাজ্য ছিল মিশরের দক্ষিণ ও পাশ্চিমের রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্যের প্রবেশ দ্বার। বাণিজ্য প্রসার ও নবলব্ধ মিশরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সিজারের মিশর রাজ্যের গর্ভনর গেইয়াস এইলিয়াস গৈইলাস দক্ষিণের কুশাইট রাজ্যের কিয়দংশ দখল করে। রানী আমানিরেনাস তার দখলকৃত অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য রেমান বাহিনীর সাথে একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হন।

 খ্রিস্টপূর্ব ২৫ অব্দে অগাস্টাস সিজার রোম সাম্রাজ্য আরব অঞ্চলে বিস্তৃত করার লক্ষে অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। এজন্য মিশর থেকে গভর্নর গেইলাসসহ বহু সৈন্য মিশর থেকে প্রত্যাহার করে আরব অঞ্চলে প্রেরণ করেন। এই সুযোগে রানি আমানিরেনাস তার বিশাল বাহিনী নিয়ে তার রাজ্যের রোমান অধিকৃত অঞ্চলগুলো আক্রমণ করে পুনর্দখল গ্রহণ করেন। এসময় তারা রোমানদের অনেক সৈন্যকে বন্দী করে রাজধানী মেরোইতে নিয়ে যান। লুন্ঠিত সম্পদের মধ্যে ছিল অগাস্টাস সিজারের একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি। এই মূর্তিকে রোমানগণ দারুন শ্রদ্ধাভক্তি করত। রানী আমানিরেনাস সেই মূর্তিটি লুট করে নিয়ে যান। তিনি রোম সম্রাটের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য সিজারের মূর্তিটি আমন দেবতার মন্দিরের প্রবেশ পথে পুঁতে রাখেন যাতে মন্দিরে প্রবেশকারীগণ অগাসটাস সিজারে মস্তকের উপর পা দিয়ে মন্দিরে ঢোকে

 কিন্তু কুশাইট রানীর বিজয় উল্লাস বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মিশরে রোমান গভর্নর গেইয়াস পাবলিয়াস পেট্রোনিয়াস দশ হাজার পদাতিক ও আটশত অশ্বারোহীর একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কুশাইট রাজ্য আক্রমণ করে। রানী আমানিরেনাসও ত্রিশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে রোমানদের মুখোমুখী হয়। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে রানীর বাহিনী পেরে উঠল না। পেটোনিয়াসের বাহিনী একটার পর একটা শহর দখল করে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রানীর কয়েকজন জেনারেল রোমান বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাদের মাধ্যমে পেট্রোনিয়াস রানীর যুদ্ধকৌশল ও অস্ত্রশস্ত্রের খোঁজ নিতে থাকেন। কিন্তু রানীর বন্দী জেনারেলগণ পেটোনিয়াসকে বিভ্রান্ত করলে রানী কৌশলে পেট্রোনিয়াসকে একটি পাহাড়ের উপর ঘেরাও করে তাকে সন্ধির  প্রস্তাব প্রেরণ করেন।

 হতবিহব্বল পেট্রোনিয়াস রানীকে স্বয়ং অগাস্টাস সিজারের কাছে উপস্থিত হয়ে সন্ধির প্রস্তাব দিতে বলেন। রানী নিজে না গিয়ে অগাস্টাসের দরবারে তার দূত প্রেরণ করেন। দূতের হাতে রানী একটি চিঠিসহ একগোছা সোনার তীর তুলে দেন। পত্রে রানী বলেন, আপনি যদি শান্তি চান, এই সোনার তীরসমুহ আপনার জন্য প্রীতি উপহার। আর যদি যুদ্ধ চান, এসব তীর আপনার যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে কাজে লাগবে।

 রানীর প্রীতি উপহারে সম্রাট অগাস্টাস সিজার মুগ্ধ হন। তিনি রানীর দেয়া সকল শর্ত মেন নিয়ে  তার সাথে সদ্ধি করেন। শর্তানুসারে রানীকে রোমানদের দখল করা নুবিয়ান অঞ্চল ফেরত  দিয়ে সিজার নুবিয়াকে সার্বভৌম সাম্রাজ্যরূপে স্বীকৃতি দেন।

 রোমান বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রানী আমানিরেনাসের একমাত্র ছেলে নিহত হয়। তিনি নিজেও একটি চোখ হারান। তাই রোমান ঐতিহাসকগণ তাকে এক চোখওয়ালী  আফ্রিকান রানী বলে থাকেন। অসম সাহসী  প্রখর যুদ্ধকৌশলের অধিকারী রানীকে ইউরোপিয়ানগণ পুরুষের বেশধারী নারী বলে উল্লেখ করত। সমসাময়িক ইতিহাসের অন্যান্য নারী শাসকগণ তাদের স্বামী বা ভাইয়ের সাথে যৌথভাবে রাজ্য শাসন করতেন। কিন্তু রানী অমানিরেনাস রাজত্ব করতেন সম্পূর্ণ এককভাবে। রানীর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে ঐতিসিকগণ মনে করেন তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১০ অব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।