পুলিশ বাহিনী বনাম সশস্ত্র বাহিনী: কেউ কারো বিকল্প নয়
পুলিশের কাজ শত্রুকে নিয়ে নয়; দেশের মানুষকে নিয়ে। দেশের মানুষ সন্ত্রাসী হতে পারে, চোর-গুণ্ডা-বাটপাড়, ডাকাত-জঙ্গি হতে পারে। কিন্তু তারপরও তারা সরকারের শত্রুু নয়, আইন ভঙ্গকারী মাত্র।
পুলিশের কাজ আইন-ভঙ্গকারীদের বিচারের মুখোমুখী করা। এজন্য তাদের শ্রম ও মধার বড় অংশ ব্যয় করতে হয় তদন্ত কাজে। অন্যান্য যে কোন কাজের চেয়ে পুলিশের তদন্তকাজটিই বেশি জটিল ও বিশেষ দক্ষতার ।
জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশের আর একটি দক্ষতা নির্দেশক বিশেষ কাজ। জনতা বিশৃঙ্খল হলেও তারা দেশের শত্রুু নয়। তাই তাদের শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার কাজটি আরও বেশি দক্ষতার দাবী রাখে।
জনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি কোন একক অফিসারের নয়। এটি দলবদ্ধ কাজ বা টিমওয়ার্ক। কিন্তু পুলিশের টিম সশস্ত্রবাহিনীর টিম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সামরিক বাহিনীতে প্রতিটি টিমের জন্য পৃথক পৃথক টিম লিডার বা কমান্ডার থাকে। পুলিশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বাহ্যিক দিক দিয়ে একই হলেও তার মাঝে আইনি দায়দায়িত্ব গ্রহণে বিশাল পার্থক্য রয়েছে।
সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষেত্রে আইনের দায়দায়িত্ব নিতে হয় তার কমান্ডারকে। সেখানে তার টিমের সদস্যরা আইনি ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাই তো যুদ্ধাপরাধের বিচারে কেবল বাহিনীর কমান্ডারদেরই শাস্তির মুখোমুখী করা হয়, সাধারণ সৈনিকদের নয়।
অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী সিভিল কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করলেও তারা বেশেষভাবে আইনি সুরক্ষা পান। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য আলাদা কোন আইনি সুরক্ষা নেই। তাই তাদের আইন দিয়েই আইন ভঙ্গকারীদের আইন দিয়েই মোকাবেলা করতে হয়। একটি টিমের অন্তর্ভুক্ত হলেও পুলিশ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথক পৃথকভাবে দায়বদ্ধ থাকে।
এখানে একটি সাম্প্রতিক বাস্তব উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। নারায়ণগঞ্চের র্যাবের দ্বারা অপহরণ ও হত্যার শিকার হওয়া সাত খুনের জন্য র্যাবের কমান্ডার লে.কর্নেল সাইদসহ সেনাবাহিনীর সৈনিকদেরও সাজা হয়েছে। কারণ তারা কমান্ডারের অবৈধ আদেশ প্রতিপালন করেছেন। এদের মধ্যে এমন একাধিক ব্যক্তি ছিলেন যারা কমান্ডারের নির্দেশে বাজার থেকে বস্তা ও রশি কিনে এনে কিছু ইঁট রশি দিয়ে বেঁধে বস্তায় ভরেছিল। কিন্তু এই ইঁটগুলো লাশের সাথে বেঁধে লাশকে পানিতে ডুবিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে ইঁটের বস্তা তৈরিকারী র্যাব সদস্যারা কিছুই জানত না। তারা কেবল কমান্ডারের আদেশ পালন করেছেন। কিন্তু খুনের সাথে কোন প্রকার সংশ্রব না থাকা সত্ত্বেও বেকল লাশ গোপনে সহায়তা করার জন্য তাদের অন্তত সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীর সদসদ্যগণ যদি একই কাজ নিজ নিজ বাহিনীর অভ্যন্তরে থেকে সম্পাদন করতেন, তবে অধীনস্ত হিসেবে তাদের কোনভাবেই শাস্তির আওতায় আনা যেত না। কারণ সব দায়দায়িত্ব নিতে হত তাদের কমান্ডারদেরই ।
কিল খেয়ে কিল চুরি করার উত্তম মানসিকতা পুলিশের কাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশৃঙ্খল জনতার হাতে পুলিশকে অহরই লাঞ্ছিত হতে হয়। এতে তারা আহত ও নিহত হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে তাদের ব্যবস্থাও হতে হয় নাগরিক বান্ধব। তারা আত্মহত্যার ব্যক্তিগত অধিকার ভোগ করতে পারলেও তার সীমা মেনে চলতে হয়। এই সীমার কোন ফিজিক্যাল বেরিয়ার নেই। সবটাই অনুমানের উপর ভিত্তি করে। আইনে বলা হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু এই মাত্রার কোন পরিমাপক নেই। এটা ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে। তাৎক্ষণিকভাবে একজন পুলিশ সদস্য বল প্রয়োগের যে মাত্রা নির্ধারণ করে, দিনের পর দিন তার চুলচেরা বিচার হয় নির্বাহী বা বিচার বিভাগীয় তদন্তে। বিচার বিশ্লেষণে তিনি নির্দোষও হতে পারেন, দোষিও হতে পারেন। উভয় সম্ভাবনা অর্ধেক অর্ধেক। এই অনিশ্চয়তা নিয়েই তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
তাই ইঁট খেয়েছে বলেই পাটকেল মারার অধিকার পুলিশের নেই। ইঁটের আঘাৎ সহ্য করেই তাদের মাঠে-ময়দানে, অফিসে-আদালতে টিকে থাকতে হয়। কিল খেয়ে কিল চুরির অভ্যসই পুলিশের বড় বৈশিষ্ট্য। জনগণের বিপরীতে জয়লাভ করার পুলিশের কোন অধিকার নেই। তাদের এমনভাবে জয়লাভ করতে হবে যেন জনগণ বোঝে তারা হেরেছে। কিংবা এমন ভাবে হারতে হবে যেন জনগণ মনে করে জিতেছে। নাগরিকদের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ জয়লাভের ধারণা পুলিশে অনুপস্থিত। তাই পুলিশকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে জীবন বিপন্নের অবস্থা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা যদি এই অভ্যাস তৈরি করে তবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষিত হবে না। পুলিশের কাছে হাজার বুলেটের চেয়ে মানুষের একটি জীবন অনেক বেশি দামী। পেশাগত জীবনে একটি বুলেট খরচ না করেই যে অবসরে যেতে পারে সেই শ্রেষ্ঠ পুলিশ অফিসার। কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীর কাছে শত্রুর হাজার জীবনের চেয়ে একটি বুলেটের দাম অনেক বেশি। একটি বুলেটের বিনিময়ে শত্রুুর হাজারটি জীবনই তাদের পেশাগত মোক্ষ। শত্রু নিধনের আগে সৈনিক মারা গেলে পরাজয় অনিবার্য। এমতাবস্থায়, পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনী একে অপরের বিকল্প হতে পারে না। যে সমাজ ও রাষ্ট্র পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনীকে পরষ্পরের বিকল্প মনে করে, তারা অচিরেই অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা ও সীমান্তে সার্বভৌমত্ব হারানোর মতো অবস্থায় পতিত হয়।