মহাজগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একপেশে দাবীর অবসান হতে আর কতদিন?
মনের প্রসারতা বাড়ানোর জন্য, আমার মনে হয়, মহাকাশ বিজ্ঞানের পাঠ নেয়া জরুরী। কি বিশাল আমাদের এই মহাবিশ্ব! বিজ্ঞানের তত্ত্বকে যদি কিছুটা হলেও মেনে নিই ( মেনে নিতেই হবে। কারণ, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কোন আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়; গাণিতিক সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।) তাহলে আমাদের স্বীকার করতেই হবে মহাবিশ্ব প্রসারণশীল এবং তার সম্প্রসারণের হার আমাদের গড় মেধার মানুষদের কল্পনার চেয়েও বেশি।
মহা সম্প্রসারণ তত্ত্বানুসারে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল, আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে। সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের বস্তুসমূহ যেমন সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি ধ্বংসও হচেছ। এ সৃষ্টি ও ধ্বংস প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি যাদের একটি হল, আমাদের এই মিল্কিওয়ে ছায়াপথ। আমাদের ছায়াপথ কোটি কোটি নক্ষত্রের সমষ্টি। প্রায় সকল নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে একাধিক গ্রহ কিংবা গ্রহাণুপুঞ্জ । গ্রহকে কেন্দ্র করে আবার ঘুরে অনেক অনেক উপগ্রহ।
এখন পর্যন্ত মানুষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগে নিশ্চিত হতে পারেনি যে আমাদের গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে থাকা গ্রহগুলোর মধ্যে পৃথিবী ভিন্ন অন্য কোন গ্রহে আমাদের মতই চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল প্রাণীর অস্তিত্ব আছে, না নেই । তবে মানুষের কল্পনাশ্রয়ী মন প্রতিনিয়তই কল্পনা করে, আমাদের মতই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রাণী হয়তো অন্যান্য গ্রহে রয়েছে যারা মাঝে মাঝে ঘটনা বা দুর্ঘটনা চক্রে পৃথিবীতে এসে ক্ষণিকের জন্য বেড়িয়ে যান। যদি আমাদের সৌরজগতের কোন গ্রহে তারা নাও থাকে, সৌর জগতের বাইরে তাদের অস্তিত্ব অপ্রমাণ করা যায় না।
পৃথিবীর বাইরে থেকে অপার্থিব বস্তুর পৃথিবীতে আসার উদাহরণ যেমন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি ধর্মীয়ভাবেও অপার্থিব বস্তু ও ব্যক্তির পৃথিবীতে আগমনের তত্ত্ব নতুন কিছু প্রবর্তনা নয়। মাঝে মাঝে উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীর আকর্ষণে প্রবেশ করে বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে জ্বলতে জ্বলতে তার ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীতে এসে পড়ে । এ ধরনের অপার্থিব বস্তুর মধ্যে রয়েছে উল্কা পিণ্ড। কোন কোন ধর্মানুসারীদের বিশ্বাস মতে কেবল উল্কাপিন্ডের মত পাথরখণ্ডই পৃথিবীতে আসেন; পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবও হয়েছিল পৃথিবীর বাইরে স্বর্গচ্যূতির মাধ্যমে। তাই আমরা, আদম সন্তানগণ আব্রাহিমিক ধর্মমতে অপার্থিব প্রাণির উত্তম উদাহরণ।
হিসেব করে দেখা গেছে, আমাদের গ্যালাক্সিতে সর্ব নিম্ন দশ কোটি ও সর্বোচ্চতিনশ কোটি গ্রহ রয়েছে। আর মহাবিশ্বে এমন গ্যালাক্সির ওরসংখ্যাই রয়েছে এক হাজার কোটির মতো। এত বিশাল এক মহাবিশ্বে মাত্র দশ কোটি গ্রহের সংখ্যা খুবই সামান্য। তাই মহাবিশ্বের ১০ কোটি গ্রহে আমাদের পৃথিবীর মতো মানুষ বা প্রাণি থাকার বিষয়টি খুব অসম্ভব নয়।
ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়া পথের অভ্যন্তরেই আমাদের পৃথিবীর মতোই বসবাসের উপযোগী তাপমাত্রার একটি গ্রহের (এক্সোপ্লানেট) সন্ধান পেয়েছেন। আমাদের পৃথিবী থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্রহটির বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘গ্লিস ১২বি’ । আমাদের পৃথিবী যেমন ৩৬৫ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, গ্লিস ১২বি গ্রহটিও তেমনি তার সূর্যকে মাত্র ১২.৮ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে।
গ্লিস ১২বি গ্রহটির নিজস্ব নক্ষত্রটি (যাকে কেন্দ্র করে গ্রহটি আবর্তিত হয়) আসলে একটি শ্বেতবামন তারকা। এ তারকার আকারে আমাদের সূর্যের আকারের মাত্র ২৭%। এর তাপমাত্রাও আমাদের সূর্যের তাপমাত্রার ৬০%। বিজ্ঞানীয়রা এ গ্রহের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলে জানতে পেরেছেন। আমাদের পৃথিবীতে এ তাপমাত্রায় মানুষের জীবন যাপন খুবই স্বাভাবিক। আমাদের পৃথিবী সূর্য থেকে যে দূরত্বে অবস্থিত, গ্লিস ১২বি গ্রহটিও তার সূর্য থেকে প্রায় তেমনি দূরত্বেই অবস্থিত। তাই মানুষের মতো প্রাণীদের সেখানে বসবাসের সম্ভাবনা রয়েছে।কিন্তু সমস্যা হল, এখানে জীবনযাপনের অত্যাবশ্যক পানির অস্তিত্ব সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কেউ যদি আমাদের পৃথিবী থেকে সৌর জগতের বাইরের এই গ্রহতে ভ্রমণ করতে চান, তবে বর্তমানের প্রযুক্তিতে প্রস্তুতকৃত সর্বাধুনিক নভোযানটির প্রায় দুই লাখ পঁচিশ হাজার বছর লাগবে। তাই আমাদের পৃথিবী থেকে ঐ পৃথিবীতে আকাশ ফেরি চালুর সম্ভাবনা আমাদের প্রজন্মের মানুষের কল্পনায় হয়তো আসবে না। কিন্তু কে জানে যে ঐ পৃথিবীর প্রাণীদের প্রযুক্তি আমাদের চেয়ে উন্নত নয়? আমরা না হয়, যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম না, কিন্তু তারা যে আমাদের গ্রহে আসার উদ্যোগ নেয়নি তা বলব কিভাবে? আমাদের যাওয়ার আগে তারা তো আমাদের পৃথিবীতে এসে পড়তেও পরে। অর্থাৎ মহাজগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একপেশে দাবীর হয়তো একদিন অবসান ঘটবে। এ অঘটন ঘটাতে পারে আমাদের মতো মানুষ কিংবা অন্য গ্রহের অন্য কোন বুদ্ধিমান প্রাণী।