স্যার, জনাব, আশয়, মহাশয়: বাঙালির সম্বোধন তত্ত্ব
সমাজে সম্বোধন প্রথার গোড়াপত্তন হয় মানুষেরর পরিবারের মধ্যেই । সন্তান ভূমিষ্ট হলেই যেমন তার জন্য একটি নামের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তেমনি পরিবারের মানুষগুলোর মধ্যে কার সাথে তার কি সম্পর্ক তাও নির্ধারিত হয়। জন্মদান সূত্রেই শিশুর প্রথম পরিচয় হয় তার মায়ের সাথে।( অবশ্য পূর্বকালে দাই আর বর্তমান কালের সিজারিয়ান অপারেশন করা ডাক্তারগণ মায়ের আগেই শিশুকে দেখেন, কোলে তুলে না নিলেও হাতে তুলে নেন।)
সম্ভবত, মানব শিশুর প্রথম সম্বোধন শব্দ হল ‘মা’। মায়ের পরে আসে পরিবারের অন্যরা। ক্রমান্বয়ে তাকে রক্তের সম্পর্কের বাইরের আত্মীয়দের সম্বোধন করতে হয়। পরিবারের গণ্ডী পেরিয়ে যখন শিশু সমাজের অংশ হয়ে ওঠে, তখন তাকে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের একটা না একটা নামে সম্বোধন করতে হয়। তবে এই সম্বোধন তাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ইত্যাদির ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। বৃহত্তর পরিবেশে মানব শিশু অন্যদের যে রীতিতেই সম্বোধন করুক না কেন, তার পরিণত বয়সের সম্বোধন রীতি মূলত পারিবারিক রীতিরই সম্প্রসারণ।
বাঙালি সমাজে সাধারণত পরিচিত সমবয়স্কদের নাম ধরে ডাকা হয়। বয়সে বড়দের ভাই কিংবা চাচা খুড়া বলে সম্বোধন চলে। অতি বয়সীদের দাদা-নানা ইত্যাদি সম্বোধনই সুবিধাজনক। কাকে কি বলে সম্বোধন করতে হবে, মানব শিশু সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেরাই তা ঠিক করে নেয়।
এখন প্রশ্ন হল, পরিবার ও পরিচিত সমাজের মানুষের বাইরে অপরিচিত বা ভিনদেশিদের কি নামে ডাকা হবে? যারা কোন অফিস আদালতে কোন ফোর্টফলিও বা দায়িত্বে নিয়োজিত নেই তাদের সম্বোধনের জন্য সামাজিক প্রথার বাইরে অন্য কোন নিয়ম বা প্রথার বালাই নেই। কিন্তু বালাই দেখা দেয় সরকারি কর্মচারী বা অন্যকোন অফিসের ফোর্টফলিও বা চেয়ারধারীদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের সরকারি অফিসে লিখিত যোগাযোগে কর্মকর্তাদের ‘জনাব’, ‘মহোদয়’ ইত্যাদি বলে সম্বোধনের নির্দেশনা রয়েছে। মৌখিকভাবে একে অপরকে পুরুষের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ ও নারীর ক্ষেত্রে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করার একটি সুপারিশমূলক প্রজ্ঞাপনের অস্তিত্ব পারওয়া যায়। তবে আমজনতা সরকারি কর্মচারীদের কি বলে সম্বোধন করবেন তার জন্য কোন লিখিত নির্দেশনা নেই।
তবে আইন বা সরকারি নির্দেশনার চেয়েও বেশি কার্যকর হল, সামাজিক প্রথা বা রীতি। এই রীতি কে, কখন, কিভাবে, কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে চালু করেছেন তার ইতিহাস জানা কঠিন। কিন্তু একবার কোন প্রথা চালু হলে, তা অনুসরণ করায় যতটুকু সুবিধা, অনুসরণ না করলে ঠিক ততোটুকুই অসুবধিা হয়। তাই পরতপক্ষে মানুষ প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে যেতে চায় না।
বাংলা-ভারত ভূখণ্ডে সরকারি প্রশাসন আদিকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল। রাজা-বাদশাদের জনগণ দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে ‘মহাশয়’ বলে সম্বোধন করত । সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ ‘আশয়’ অর্থ হল ‘হৃদয়’ বা ‘অন্তকরণ’। আর যার হৃদয় বা আশয় বড় বা মহান সেই হল মহাশয়। রাজা-বাদশাগণ যতই ক্ষুদ্র মনের অধিকারী হোক, তারা জনগণের উপর যতই নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করুক, তাদের ‘মহাশয়’ না বলে উপায় নেই। যাহোক, এ মহাশয় শব্দটিই কালক্রমে ‘মশাই’ রূপ লাভ করে। কেউ কেউ রাজপদবির পরে ‘বাহাদুর’ ব্যবহার করতেন। যেমন, রাজামশাই, কিংবা সরকার বাহাদুর’ ইত্যাদি।
রাজ-রাজড়াদের প্রশাসনিক কর্মচারীদের পদবির সাথে মশাই, বা বাবু ও কোন কোন ক্ষেত্রে ‘কর্তা’ বলে সম্বোধন করার রীতিও বেশ পুরাতন। বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের পাতায় খাতকগণ মহাজনদের, প্রজারা জমিদার কিংবা জমিদারদের নায়েবদের ‘কর্তা’ বলে সম্বোধন করত। ঐ সময় রাজকর্মচারীদের সম্বোধনে তেমন কোন সমস্যা হত না। থানার কর্মচারীদের দারোগা বাবু বললেই ল্যাটা চুকে যেত। সংখ্যায় বেশি হলে বড়বাবু, ছোট বাবু ইত্যাদি বললেই কেল্লাফতে। কিন্তু সরকারি প্রশাসনের দ্রুত বিস্তৃতি ও তৃণমূলে পদার্পণে একটি সাধারণ সম্বোধন রীতি চালুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। এসময় দেশি কর্মচারিদের বাবু বললেও সাদা চামড়ার বিদেশিদের বাবু বলার উপায় ছিল না। তাই তাদের জন্য একটি ভিন্ন সম্বোধন রীতি চালুর দরকার দেখা দেয়।
ব্রিটিশ সরকারের অভিজাত শ্রেণির সদস্যরা নাইট বা ব্যারণ নামে পরিচিত। নাইটহুড তারা উত্তরাধিকারসূত্রে কিংবা রাজানুগ্রহে প্রাপ্ত হত। নাইটদের নামের আগে ব্যবহার করা হত লর্ড। সাধারণ মানুষ তাদের সম্বোধন করতেন ‘স্যার’ বলে।
বঙ্গ-ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসন চালু রাখার জন্য কিছু সাদা চামড়ার মানুষের প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য ঐ দেশের নাইট বা লর্ডদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাওয়া গেলেও তৃণমূলের শাসন মজবুদ রাখতে দরকার পড়ে অতি সাধারণ ঘরের বিলেতিদের। এই বিলেতি প্রশাসকগণ ঐ দেশে অচ্ছূত শ্রেণির হলেও ভারতে এসে স্বঘোষিত লর্ড বনে যান। এমন কথা প্রচলিত আছে যে, বিলেতের ভাগ্যান্বেষী সাধারণ ঘরের সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টটি ভারতের পুলিশ বাহিনীতে এবং অপেক্ষাকৃত কম দুষ্ট কিন্তু কিছুটা বিদ্যাবুদ্ধি আছে এমন পোলাপানদের সাধারণ প্রশাসনে যোগ দেয়ার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হত। হয়তো নিজ দেশে অভিজাত নাইটদের ‘স্যার’ ‘স্যার’ বলে তোয়াজ করা এই দুষ্ট প্রকৃতির পোলাপানগুলোই ভারতে শাসক-প্রশাসক ও মিলিটারি-পুলিশের কর্তাব্যক্তি হয়ে ভারতবাসীদের কাছ থেকে স্যার সম্বোধনের রীতি চালু করেছে।
ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে ১৯৪৭ সালে। এরপর তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে অর্ধশত বছর আগে। কিন্তু ব্রিটিশদের চালু করা স্যার সম্বোধনটি পরিত্যাগ করার কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত কেউ গ্রহণ করেনি। বলতে কি, এটা পরিবর্তন করার পক্ষে জোর দাবী তো দূরের কথা এখন পর্যন্ত কেউ মৃদু দাবীও তোলেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত হচ্ছে। তাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধিও নানা মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি প্রশাসনের বাইরেও শত শত আধা সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে, বিস্তার ঘটেছে ও শক্তি বেড়েছে। তাই কে কার উপরে বা নিচে কিংবা সমান্তরালে এমন প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারিদের সম্বোধন রীতির আড়াইশ বছরে স্যার বলার অনুশীলন বাতিল করে এখন পর্যন্ত কোন সরকারি ঘোষণা জনগণের সামনে উপস্থিত করা হয়নি। তাই সরকারি কর্মচারীদের কেউ কেউ যদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে স্যার’ সম্বোধন পেতে লালায়িত হন, সেটাকে অবৈধ বা অপ্রাসঙ্গিক প্রত্যাশা বলা যায় না। একইভাবে কেউ যদি স্যার বলতে অস্বীকার করে, ভাই, দাদা, আপা, চাচা বলেন, তাকেও হেস্তনেস্ত করার কোন কারণ দেখি না। তবে প্রতিষ্ঠিত আচারকে পরিবর্তন করে নূতন কোন আচার অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন। হয়তো জনদাবীর মুখে সরকারি কর্মচারীদের ‘স্যার’ সম্বোধন করার প্রথায় পরিবর্তন আনা হবে। তবে সেটা আশয়, মহাশয়, জনাব, মহোদয় যাই হোক না কেন, আড়াই শত বছর ধরে প্রচলিত কোন সামাজিক রীতির পরিবর্তন রাতারাতি তো নয়ই, আড়াই দশকেও করা সম্ভব নয়।