উচ্চ শিক্ষার বিলাশিতা নয়, বেঁচে থাকার জন্য কারিগরী শিক্ষা চাই

‘দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’। জানুয়ারি.২০২২ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার এ শিরোনামের খবরটি সকল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। খবরে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্র বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এক যুবক কেবল দুই বেলা ভাত খাবারের বিনিময়ে ছাত্র পড়াতে চান। উচ্চ শিক্ষিত এই যুবকের কাহিনীতে অনেকের বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু আমি অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। এমন ধরনের আরও অনেক খবর অহরই প্রকাশিত হচ্ছে যেখানে উচ্চ শিক্ষিত যুবক যুবতীরা কেউ রিকসা চালাচ্ছেন, কেউ বা ফুট পাথে পিঠার দোকান দিয়ে রুটিরুজি কামাই করছেন
অনেকে এসব খবরে আমাদের অর্থনীতির দুরবস্থা বর্ণনা করছেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এখানে অর্থনীতির দুরবস্থান না দেখে আমাদের যুব সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুরবস্থা দেখছি। এসব ঘটনায় স্পষ্টতই বোঝা যাচেছ আমাদের যুবকদের ঢালাওভাবে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের প্রবণতা এবং তারই সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ। আমি ঢালাওভাবে সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার বিরুদ্ধে। কয়েকটি ব্যক্তিগত ঘটনারা মাধ্যমে আমি আমার মত পরিষ্কার করব। আমার যুক্তির সপক্ষে উদাহরণগুলো বাস্তব ও আমার নিজের সাথে আমার ঘনিষ্ট বন্ধুদের সাথে সম্পর্কিত। তাই গল্পে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের ছদ্মনাম ব্যবহার করছি।
আমার উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির বন্ধু সুদর্শন শাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে একটি ছোট চাকরিতে যোগদান করে। চাকরিটি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট পরীক্ষক। ছাত্রজীবনে বন্ধুর কাছে মতিঝিলে প্রায়ই যাওয়া হত। কি সে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা সেই সেকশনে! আমরা তার সাথে দেখা করতাম। সে আমাদের ব্যাংকের কেন্টিনে পেট পুরে খাওয়াত। বন্ধু বলত, আমরা অনেক বড় হব। কিন্তু সে ছোটই থেকে যাবে। মনে মনে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কল্পনার সাথে সাথে বন্ধুর চোখে হতাশাও দেখতাম।
পড়াশোনা শেষ করে আমি চাকরির চেষ্টা করছি। আমাদের কেউ কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার পদে নির্বাচিত হয়ে চাকরি শুরু করল। কিন্তু আমাদের সেই এইচএসসি পাশ করা বন্ধুটিও ততোদিন পদোন্নতি পেয়ে অফিসার পদে উন্নীত হয়েছে। এরপর আমাদের বন্ধুদের (যারা এমএসসি/এমএ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে অফিসার পদে যোগ দিয়েছিল) পদোন্নতির সময় হল। আমাদের সেই ছোটকালের বন্ধুটিরও তখন পদোন্নতির সময় হল। কারণ সে গত পাঁচ/সাত বছরে অনেগগুলো পদোন্নতি পেয়ে আমাদের পদেই চাকরি করছিল। কিন্তু পদোন্নতির তালিকায় আমাদের ছোটকালের বন্ধুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারী বন্ধুদের চেয়ে এগিয়ে থাকল।
এবার আমরা শুরু করলাম কঠোর বিশ্লেষণ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চাকরি বা কর্মজীবনে প্রবেশ করা আমাদের বন্ধুটির সাথে মেলাতে চেষ্টা চলল। উচ্চশিক্ষার পরে ও উচ্চ শিক্ষার পূর্বেই একটা কাজে যোগদান করে ও উচ্চ শিক্ষালাভ করে একই পদে যোগদান করে কার কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হয়েছে?
আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স-মাস্টার্স করা বন্ধুরা, হিসেব করে দেখলাম, আমাদের উচ্চ শিক্ষিত বন্ধুরা হাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য যে অর্থ, সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করেছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিহীন বন্ধুটির অর্জন তার চেয়ে অনেক বেশি। সে এর মাঝে একটি সংসার পেয়েছে। তার একটি সন্তান আছে। তার একটি বাড়ি না হলেও ঋণের অর্থে কেনা ঢাকা শহরে একটি প্লটও রয়েছে। সবচেয়ে মাজার ব্যাপর হল, আমরা যে ডিগ্রি নিয়ে এত বড়াই করছি, আমাদের বন্ধু তলে তলে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে সেই সমমানের ডিগ্রিটিও অর্জন করেছে। অন্তত কাগজে কলমে সে এখন আমাদের সমান শিক্ষিত। হ্যাঁ, তার সাথে প্রতিযোগিতায় যেতে হলে আমাদের বাস্তব অর্জন নয়, কাগজ কলমেই যেতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা তার ধারের কাছেও গেলাম না, কাগজ কলমেও তার চেয়ে বেশি হতে পেলাম না।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আমাদের সামান্য ক’জন বন্ধু হয়তো সেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা বন্ধুর চেয়ে কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু গড় পড়তা সবাই তার সমমান কিংবা তার নিচেই রয়েছি। আমাদের ঢাবি পাশ করা বন্ধুদের অনেকেই এখন হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক, কেউ কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ঢুকেছে। আমাদের অনেক বন্ধু বেসরকারি স্কুল কলেজেও ঢুকেছে। কেউ কেউ এনজিওতেও ঢুকেছে।
এসব গেল তো ঢাবি থেকে পাশ করা বন্ধুদের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স কলেজগুলো থেকে যারা পাশ করেছে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। তা গড়পড়তা সুদর্শন সাহার জীবনের অর্জন আমাদের উচ্চ ডিগ্রিধারী (যদিও সেটা আমাদের দম্ভমতে) বন্ধুদের চেয়ে অনেক বেশি। এর কারণ সে উচ্চ শিক্ষা পিছনে না ছুটে যৌবনের শুরুতেই কর্মে ঢুকেছে, নিজেকে স্বাবলম্বী করেছে।
অনেকে বলবেন, চাকরিবাকরি করে প্রাইভেটে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন কিংবা এইচএসসি পাশ করার পর কর্মজীবন শুরু করলে মানুষের জীবনবোধ উন্নত হয় না। হতে পারে অল্প শিক্ষিত মানুষের চেয়ে আমাদের মতো শিক্ষিত মানুষের জীবনবোধ উন্নতর। কিন্তু যে জীবনবোধ মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরিবর্তে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে অনুপ্রেরণা দেয়, সেই জীবনবোধ দিয়ে আমি কি করব?
আমি কোনভাবেই উচ্চ শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছি না। উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু গড়পড়তা নাগরিকের উচ্চশিক্ষা বিলাশিতামাত্র। আমি মনে করি, উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন সহজলভ্য হওয়া উচিৎ নয়। এ ডিগ্রি অর্জন দুই দিক দিয়ে কঠিন করে তোলা উচিৎ,
প্রথমত, মেধাগত দিক দিয়ে। যারা অনেক বেশি মেধাবী কেবল তারাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন তারা হবেন গবেষক, শিক্ষক ও সরকার পরিচালনার জন্য উপযুক্ত কেউ।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন অর্থের দিক দিয়েও কঠোর হওয়া উচিৎ। মেধার সাথে যাদের অর্থের সম্মেলন ঘটবে কেবল তারাই নিজেদের মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবেন। কেউ কেউ মনে করবেন, তাহলে আমি কি গরীব মানুষের জন্য উচ্চ শিক্ষার দুয়ার বন্ধ করে দেয়ার ওকালতি করছি । না, তা আদৌ নয়, যারা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র, উচ্চ শিক্ষার জন্য তাদের বৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে। সরকারি হোক, বেসরকারি হোক, সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত অর্ধেক ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিয়ে পড়ার সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনবোধে মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে যার উদাহরণ পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। এসব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশের ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মেধাবীগণ বিত্তবানদের পাশাপাশি সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক আনুকুল্যে এগিয়ে যাবে।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যে শিক্ষা হবে সেখানে সাধারণ বিষয়াবলীর পাশাপাশি কারিগরী বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে। শিক্ষার পাঠ্যক্রম এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে এইচএসসি পাশ করা প্রত্যেক তরুণ যেন অন্তত একটি বিষয়ে সাধারণ কারিগরী জ্ঞানে মধ্যমমানের পারদর্শীতা অর্জন করে। এ জন্য তাদের এইএসসি পরীক্ষায় অন্তত একটি বিষয়ে বাস্তব কারিগরী জ্ঞানার্জনের জন্য ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা থাকার দরকার রয়েছে। এমন কি এ ব্যবহারিক শিক্ষা যদি স্মার্টফোন সার্ভিসিং করার শিক্ষার মতো মামুলি শিক্ষাও হয়, তাও করা দরকার।
নিবন্ধের শুরুতে আমরা রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী যে যুবকের কথা বলেছি, তিনি তার শিকি শতকের জীবনে কি অর্জন করেছেন? কাগজের একটি সনদের কি মূল্য আছে সে যদি আমার জীবনের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে না পারে? উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কি করব, যদি না আমাকে সেই শিক্ষা একটি পেশার বা তৃত্তির জন্য উপযুক্ত করে তুলতে না পারে?
শুকুমার রায়ের 'জীবনের হিসাব' কবিতার সেই বাবু সূর্য ওঠা-ডোবার ভৌগোলিক জ্ঞান থেকে শুরু করে চন্দ্রগ্রহণের কারণ পর্যন্ত জেনে ফেলেছেন। কিন্তু তার জীবন বাঁচানোর জন্য সামান্য সাঁতারটুকুও জানেন না। তাই পূঁথিগত শিক্ষায় সে মহাজ্ঞানী হলেও জীবন রক্ষার বিদ্যায় নৌকার মাঝির চেয়েও মূর্খ।
তাই, এখনি সময়, বিলাশিতার উচ্চ শিক্ষা নয়, জীবন ধারণের জন্য কারিগরী শিক্ষাই যুবকদের জন্য সহজলভ্য করুন। প্রয়োজনে উচ্চ শিক্ষাকে কঠিন করে কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করুন।