মহাবিশ্ব সৃষ্ট্রির প্রথম তিন মিনিট: কিভাবে এল আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব?

কিভাবে সৃষ্টি হল আমাদের এ মহাবিশ্ব? ধর্ম ও বিজ্ঞান এ সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে। ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বিশ্বাস নয়, জানতে হয়, অনুধাবন করতে হয়। যারা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী তাদের জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা অত্যন্ত জরুরি। আমার এ নিবদ্ধে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যই আলোচনা করব।
অনেকেই মনে করেন, আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে একটি প্রচণ্ড নিনাদে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিগব্যাং সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি অনেকটাই অসম্পূর্ণ। আসলে আমাদের মহাবিশ্ব শূন্য সময়ে সৃষ্টি হয়নি। এটি সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল শূন্য সময়ের পরে। একের পরে ৪৩টি শূন্য দিলে যে সংখ্যাটি পাব তাকে দিয়ে এক সেকেন্ডেকে ভাগ করলে যে সময়টুকু পাব আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল ঠিক সেই সময় থেকেই। এর পর তিন মিনিট অতিক্রান্ত হওয়া পর্যন্ত কত কি যে ঘটেছিল তা কি কেউ কল্পনা করতে পারে? কিন্তু বিজ্ঞান তো কল্পনারই বাস্তব রূপ। মহাকাশি বিজ্ঞানীরা তাদের যৌক্তিক কল্পনাকে গণিত ও কোয়ান্টাম পদার্থ বিদ্যার সূত্রে বসিয়ে সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের সাথে তিন মিনিট যোগ করে প্রাপ্ত সময়ে মহাবিশ্বের সৃষ্ট্রি প্রক্রিয়াকে সাতটি পর্ব বা যুগে বিভক্ত করেছেন। আজ আমরা মহাবিশ্বের যে শক্তির সমাহার ও বস্তুগত রূপ দেখি তার সব কিছুর গোড়া পত্তন হয়েছিল এই তিন মিনিটেই। এবার আমরা সেই তিন মিনিটের ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে বর্ণনা করব।
প্ল্যাঙ্ক মহাযুগ:
বিগব্যাং বা মহাসম্প্রসারণ ঘটার পরে প্ল্যাঙ্ক যুগ হল প্রথম যুগ। প্ল্যাক যুগ বা সময় হল সেই সময় যা প্ল্যাঙ্ক দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর প্রয়োজন পড়ে। এ সময়টি হল ১০-৪৩সেকেন্ড। এ সময় মহাবিশ্ব এত বেশি উত্তপ্ত ছিল যে তার তাপমাত্রা১০৩২ কেলভিন পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। এ সময় তাই মহাবিশ্বের চারটি বল যথা, অভিকর্ষ বল, বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় বল, দুর্বল বল ও সবল বল একীভূত অবস্থায় ছিল। যেহেতু এ যুগে পদার্থ বিদ্যার প্রচলিত সূত্রগুলো সম্পূর্ণ অচল ছিল, তাই এ কালে আসলে কি কি ঘটেছিল তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।
মহাসমন্বিত-তত্ত্ব যুগ
প্ল্যাঙ্ক যুগের শেষে ১০-৩৬ সেকেন্ড সময় পর্যন্ত মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বলটি আলাদা হয়ে যায়। এ সময় তড়িৎ-চুম্বকীয় বল, দুর্বল ও সবল নিউক্লিয় বল মিলে একত্রে অবস্থান করে। এ সময় মহাবিম্ভের তাপমাত্র সামান্য কমে১০২৯ ডিগ্রি কেলভিনে দাঁড়ায়। একটি বল ভিন্ন অন্য তিনটি বলের একত্রিত থাকায় এ যুগটিকে তাই মহাসমন্বিত-তত্ত্ব যুগ বলে অবিহিত করা হয়।
সম্প্রসারণ ও তড়িৎ দুর্বল বলের যুগ
বিগব্যাংগের ১০-৩৩ সেকেন্ড পরে একত্রে থাকা তিনটি বলের মধ্যে তড়িৎ চুম্বকীয় বলটি এ সময়ে আলাদা হয়ে যায়। এ সময় কেবল পারমাণবিক সবল ও পারমাণবিক দুর্বল বল দুটোই একত্রে অবস্থান করে। এ সময় মহাবিশ্ব আলোর চেয়েও বহুগুণ বেশি গতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে যা একটি নিউক্লিয়াসে থাকা একটি প্রোটনের সমান আকার থেকে হাতের মুঠোর সমান আকার ধারণ করে। তবে তখনও পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলো মহাবিশ্বে কার্যকরী হতে শুরু করেনি।
বিগ ব্যাঙের ১০-৩৩ সেকেন্ড পরই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি কমে গিয়ে বর্তমানের গতি ধারণ করে। এ সময়টি চলতে থাকে ১০-৩২ সেকেন্ড সময় পর্যন্ত। এ সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রায় ১০০ ট্রিয়লিয়ন কেলভিনে নেমে আসে। সবচেয়ে বড় হল বিষয় হল, এসময় ডাব্লিউ ও জেড বোসন গঠিত হয়। এগুলো হল আধা-পারমাণবিক কণা যেগুলো দিয়ে পরমাণুর কণাগুলো তৈরি হয়।
কোয়ার্ক বা মৌলিক কণার যুগ
বিগ ব্যাঙ্গের ১০-১২ সেকেন্ড পরের যুগে তড়িৎ-চৌম্বকীয় বল ও দুর্বল নিউক্লিয়-বলও আলাদা হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে মহাজগতে ক্রিয়াশীল সবগুলো বলই তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয়। এ যুগের তাপমাত্রা এমন অবস্থায় থাকে যেখানে হিগস ফিল্ড কাজ করা শুরু করে।( হিগস ফিল্ড হল এমন একটি ফিল্ড যার ভিতর দিয়ে মৌলিক কণাগুলো চলাচল করলে বাধা প্রাপ্ত হয়ে ভর গ্রহণ করে।) ফলে বস্তু বা ম্যাটার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় কণিকাগুলো মুক্তভাবে চলাচল শুরু করে । হিগস ফিল্ড অতিক্রম করাকালীন কণাগুলো প্রয়োজনীয় ভর অর্জনে সক্ষম হয়ে ওঠে। এ সময়ে গঠিত হওয়া কনিকাগুলোকে এতত্রে কোয়ার্ক বলা হয়। তবে এ সময়েও মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে কোয়ার্ক কণাগুলো একত্রিত হয়ে হ্যাড্রন কণা ( প্রোটন ও নিউট্রন) গঠনের সুযোগ পায়নি।
হ্যাড্রন কণার যুগ
হ্যাড্রন কণা হল, কয়েকটি কোয়ার্ক কণার সমন্বয়ে গঠিত মৌলিক কনা। এ সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এমন অবস্থায় নেমে আসে যাতে কোয়ার্ক কণাগুলোর একত্রিত হয়ে হ্যাড্রন কণিকা গঠন করতে সমর্থ হয়। এ সময় অবশ্য একই সাথে এন্টিম্যাটারও গঠনের প্রক্রিয়ায় অ্যন্টি হ্যাড্রনও তৈরি হয়েছিল। তবে হ্যাড্রন-অ্যান্টিহ্যাড্রন সংঘর্ষে অ্যান্টি হ্যাড্রন বিলুপ্ত হয়ে হ্যাড্রন কণা স্থিতি লাভ করে। এসময় তাই কেবল আলোকসহ হ্যাড্রন কণা প্রোটন ও নিউট্রনই অবশিষ্ট থাকে। হ্যাড্রন যুগ বিগব্যাংশ শুরুর পর এক সেকেন্ড পরেই সমাপ্ত হয়।
লেপ্টন কণার যুগ।
মহাবিশ্বের বয়স এক সেকেন্ড হলে এর তাপমাত্রায় যে পরিবর্তন আসে তাতে অন্য এক শ্রেণির কণিকা গঠিত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয় যার নাম দেয়া হয়েছে লেপটন । এ ধরনের কণিকাগুলোর ধ্রুপদি উদাহরণ হল, ইলেকট্রন। বরাররের মতো এ পর্বেও লেপ্টন ও অ্যান্টিলেপ্টনের যুদ্ধ চলে। পরে লেপ্টন কনা টিকে থাকে। মহাবিশ্ব সূচনার দশ সেকেন্ড পর্যন্ত লেপ্টন ও অ্যান্টি লেপ্টনের সাম্য চলতে থাকে। এ সময় ফোটোনের শক্তি এত বেশি ছিল যে ইলেক্ট্রন-পজিট্রন যুগল তৈরি সম্ভব হয়নি। ইলেক্ট্রনের মুক্ততার জন্য ফোটন সহজেই বিচিছন হতে পারে বলে এ সময় মহাবিশ্ব অনেকটা অস্বচ্ছ আকার ধারণ করে।
নিউক্লিয়সিনথেসিস বা নিউক্লিয়াস গঠনের যুগ
মহাবিশ্ব তৈরির দুই সেকেন্ডের মধ্যেই মহাবিশ্বের সকল বল আলাদা আলাদা বিশিষ্ট্য ধারণ করে এবং মৌলিক কণিকা প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন ও ফোটনও তৈরি হয়। তবে এ সময় প্রভূত্ব করত ফোটন কণা। কারণ এ সময় প্রতি বিলিন ফোটন কণার বিপরিতে মাত্র একটি অন্যান্য কণার অস্তিত্ব ছিল। ইতোপূর্বে মহাবিশ্বের তাপমাত্রার আধিক্যের জন্য কণিকাগুলো একত্রিত হয়ে কোন নিউক্লিয়াস গঠন করতে পারেনি। কণিকাগুলো একত্রিত হয়ে বস্তুর নিউক্লিয়াস গঠন শুরু করে। তাই এ সময়কে বলা হয় নিউক্লিয়সিনথেসিস। এ সময়েই আমাদের মহাবিশ্বে প্রাপ্ত সকল প্রকার ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি হয়।
মহাবিশ্বের বয়স দুই মিনিট পার হলে এর তাপমাত্রা ১.২ বিলিয়ন ডিগ্রি ক্যালভিনের নিচে নেমে আসে। এ সময় ফোটনের গড় শক্তি ১.৮x১০-১৪ জুল ছিল। এ শক্তি দিয়ে প্রাপ্ত তামপাত্রায় ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াস গঠনের উপযুক্ত হয়। একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন সবল নিউক্লিয় বলের প্রভাবে বিগব্যাংগের দুই মিনিট পরে প্রথম একটি ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে। এটাই ছিল ফোটনের পরে প্রথম জটিল নিউক্লিয়াস।
বিগব্যাঙ্গের তিন মিনিট পরে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এক বিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিনেরও নিচে নেমে আসে। এ তাপমাত্রায় ফোটনের শক্তি দাঁড়ায় ১.৫x১০-১৪ জুল। এ শক্তিতে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠনের উপযুক্ত হওয়ায় তিন মিনিটের মাথায় ডিউটেরিয়াম, প্রোটন ও নিউট্রোন একত্রিত হয়ে প্রথম হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে।
সংক্ষেপে বলা যায়, মহাবিশ্ব অস্তিত্বশীল হওয়ার প্রথম তিন মনিটের পরেই প্রোটন ও নিউট্রন একত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়া ডিউটেরিয়াম অণু তৈরি করে। এরপর ডিউটেরিয়াম অনুগুলো পরষ্পরের সাথে মিলে হেলিয়াম-৪ অণু তৈরি করে। অর্থাৎ এই তিন মিনিটেই ভিভিন্ন যুগ অতিক্রম করে আমাদের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যক প্রথম দুইটি বস্তু হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম তৈরি করে মহাবিশ্বকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার উপযুক্ত করে তোলে যার মাধ্যমেই আমরা আজকের মহাবিশ্বকে পেয়েছি।।