অমিমাংসিত ভ্রম
,
এক মধ্যরাতের নেশাঘুম ভেঙে রাত্রিজাগা নক্ষত্রের আলোয় আমার ছোট দাদি ঘর ছেড়ে, রাত ছেড়ে, শয্যা ছেড়ে, অন্ধকারের উষ্ণতা ছেড়ে, কত রোমাঞ্চিত আবেশ ছেড়ে, দাদার শরীরের গন্ধ ছেড়ে,পরাবাস্তবতার অবচেতন ঘোরে হাঁটতে থাকে জঙ্গলাভিসারে। সাথে হাঁটে আরও তিন-চারজন বিংশের নব্বইয়ের শেষের সাহসী প্রৌঢ়া নারী।
চিরকাল জন্ম বিশ্বাস মেনে যে ঘরকে মন্দির বা মসজিদের মত উচ্চে রাখে স্বেচ্ছাবরণী অবলারা, আবার ঠুনকো আঘাত,আবেগে নিমিষেই ত্যাগ করে সে ঘর, দম্ভ কিংবা অভিমানে। কী বিচিত্র নারী মন! দাপটী দাদীর সংসারে অমর্যাদা কিংবা ত্রুটি এসবের কিছুই ছিল না। তবু দাদি ফেলে যায় নিরাসক্ত রাত্রির বেদনা আর দাদার শূন্য বুক।
ভিন দর্শনে প্রভাবিত সমাজ বিভাজিত এই নারীরা ঘন জঙ্গলে গড়ে দরগাহ ঘর।বাঁশের বেড়া ও ছনের কুটির,ডাল-পাতায় আচ্ছাদিত সীমানা, বাড়ি থেকে অনিচ্ছায় যুক্ত চৌকি,বিছানা আর হাঁড়ি-পাতিলের সাথে জঙ্গলে অন্ধকারে নিভূতবাসে অংশ নেয় দাদির তিনজন বেপথু সখী। এছাড়া তৃতীয় পক্ষ কারো কারো অযাচিত আগমন জঙ্গলের নিয়ম ভেঙে প্রৌঢ়াদের সঙ্গ,সময় মধুময় করে। মৃত্যুপুরীর মত ভয়ংকর, দূরপাশ দিয়ে হাঁটতে গা ছমছম করে,সে জঙ্গল আজ পরিবার বিচ্ছিন্ন সমাজের বিপরীত স্রোতে চলা দ্রোহী নারীর নির্জন ধ্যানস্থান। সেখানকার কুপির শিখা লোকালয় ছুঁলেও দাদার সাথে দাদির দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমশ..
স্বেচ্ছা নির্বাসিত মুক্ত জীবনে যে নিছক আনন্দ খুঁজে পায়, ঘরবন্দি ভালোবাসার মায়ায় সে অকারণ বাঁধা পড়ে না।তাই দাদার সেই একক গৃহবাস।পড়ে থাকে শূন্য শয্যা দাদিকে অনেক বুঝিয়েও বশে আনতে পারেন না প্রেমিক দাদা।
এখন দাদির কথা হয় জ্বীনের সাথে। একজন পৌরুষদীপ্ত তরুণ জ্বীনকে দাদি ‘ভাই' বানিয়েছে।নাম মাদার।যে গাছে সে থাকে,সেটি ভুলবশত কাটতে গিয়ে বড় দাদার কুঠারের আঘাতে মাদারের মাথা ফাটে। জ্বীনের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। হয়তো প্রতিশোধে ধ্বংস করে দিতে পারত এই অপ্রতিরোধ্য দানব আমাদের বৃহৎ পরিবার। কিন্তু স্নেহকাতর জ্বীনভাই দাদির ভালোবাসার সম্মানে ক্ষমা করে।মাঝে মাঝে দাদিকে হারানো জিনিস খুঁজতে,অথবা কারো উপর জ্বীনের আঁচড় আছে কী না তা নিরীক্ষণ করতে হয়। তখন ধ্যানমগ্ন দাদি সুর করে গণক দেয়। গোপন সত্য প্রকাশের চেষ্টা করে।তবে চেতন অবস্থায় যে সূরাগুলো সন্ন্যাসিনীদের পক্ষে দেখে সাবলীল পাঠও দুর্বোধ্য, আধ্যাত্মিক ঘোরে তা অবিশ্বাস্য রকম মুখস্থ বলা সত্যিই বিস্ময়!
মাঝে মাঝে ওদের (জ্বীন)মনোরঞ্জনের জন্য হয় গোমড়া নাচ। লাঠিখেলাও।আদিবাসী ঢুলিদের মাতালঢোলবোলে আর শরীরী কসরতে কাগজের ঘোড়ার নাচে তাল মিলিয়ে পাগলের মতো নাচে দাদি আর সখীরা। দাদি বিদ্রোহী স্টাইলে হাত-পা আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে নাচে। মনে হয় নিমিষেই সমাজ,নিয়ম প্রত্যাখান করা দুর্বার আমিত্বের অহংকার!সখীরা কেউ কেউ মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘুরে ঘুরে, অথবা বেতালে উল্টো-পাল্টা শরীরী অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটায়। তখন বেসামাল মগ্নতায় কারো কারো আঁচল খসে পড়ে।স্বভাববিরুদ্ধ নিয়মবিরুদ্ধ এমন আচরণে দাদা মুখ ফিরিয়ে নিলেন স্বেচ্ছায়।
সাথে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের অংশগ্রহণে এই নাচের বড় বহরটি পাশে জঙ্গলাচ্ছন্ন আঁধারমেশা দরগায় গিয়ে থামে খই-মুড়কি বিতরণের মধ্য দিয়ে।তারপর সারিবদ্ধ ছেলে- মেয়েদের চুনমাখা বড় কাঠগাছের নিচে বসানো হয়।
সবাইকে কলাপাতায় গন্ধ চালের মোরগ পোলাও খেতে দেয়। কিন্তু দাদির হুঁশিয়ারি "আগে আমার ভাই খাবে"। চুনলেপা পরিষ্কার আসন, চিনামাটির সাদা থালা আর স্বচ্ছ জলভরা কাঁচের গ্লাস।তখন নিজের খাবার ভুলে আমি অদৃশ্য দানবের অস্তিত্বে নিমগ্ন বড় গাছের নিচে হলুদ ভাতে আর এক গ্লাস কাঁচপানিতে।নিমিষেই অর্ধেক এবং পরে শুন্য। আমার ছোট্ট মনে তোলে অবাক প্রশ্নের ঝড়।পুনরায় থালা এবং গ্লাস ভরানোর অমিমাংসিত ভ্রম রয়ে যায় মনে।
কালপথ বেয়ে জীবনে অনেক সময় পাড়ি দিয়ে পরিণত হয়েছি,দাদাও অন্তিমে এসে পৌঁছেছেন,তবু অকস্মাৎ দাদির ঘরছাড়া আর আমার দৃষ্টিভ্রমের রহস্য আজও জানা হয়নি...