পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে শিক্ষকের মর্যাদা

পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে শিক্ষকের মর্যাদা
মো: রায়হানুর রহমান, সহকারী শিক্ষক
শিক্ষক হলেন জাতি গঠনের কারিগর। বাংলায় শিক্ষক শব্দকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই: শি-শিষ্ঠাচার, ক্ষ-ক্ষমাশীল এবং ক- কর্তব্যপরায়ণ। আর ইংরেজিতে TEACHER কে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই, T-Tactful (কৌশলী), E-Efficient (দক্ষ), A-Amiable (বন্ধুসুলভ), C-Co-operative (সহযোগী), H-Honest (সৎ), E-Educated (শিক্ষিত), R-Regular (নিয়মিত)। আরবি ভাষায় শিক্ষক বলতে বুঝায়-মুয়াল্লিম, উস্তাদ, শায়খ, আলিম ইত্যাদি। সাধারণত: যিনি জ্ঞানের ধারক ও বাহক, যিনি জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ি নিজে আমল করেন এবং অন্যের কাছে জ্ঞান বিতরণ করেন তাকেই শিক্ষক বলা হয়। মানুষের জন্য মহান আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো জ্ঞান। এ জ্ঞানের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’। তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।[1] কিন্তু পরে যখন আদম (আ) কে সে সকল বস্তুর নাম বলতে বললেন, তখন তিনি সেগুলোর নাম বলে দিলেন। এভাবে জ্ঞানের মাধ্যমে আদম (আ) ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে আলিম (তথা শিক্ষক) এর মর্যাদা অনেক।
শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বাণীসমূহ: মহান আল্লাহ বলেনঃ‘‘বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে।’’[2] আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ ‘বল, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’[3] মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেনঃ ‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে জ্ঞানসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।’[4] অন্যত্র বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।’[5] জ্ঞানীদের মর্যাদার বিষয়টিও আল্-কুরআনে একাধিকবার ব্যবহার করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে আর যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ্ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন।’[6] আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তিনি যাকে চান, হিকমত দান করেন। আর যে ব্যক্তি হিকমত লাভ করে সে আসলে বিরাট সম্পদ লাভ করেছে। এই কথা থেকে কেবলমাত্র তারাই শিক্ষা লাভ করে যারা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী।”[7]
শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসের বাণীসমূহ: আমাদের প্রিয়নবি (সা) নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেছেন, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।[8] রাসূলুল্লাহ (সা) শিক্ষকদের মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, সন্দেহ নেই, যিনি মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা দেন, তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন। তাঁর ফেরেশতাকুল, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের ভেতরে থাকা পিঁপড়া এবং মাছও তাঁর জন্যে দুআ করে।[9] রাসূলুল্লাহ (সা) শিক্ষকের জন্য দোআ করে বলেছেনঃ আল্লাহ সে ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার কোন কথা শুনেছে, অতঃপর এ কথাকে স্মরণ রেখেছে ও রক্ষা করেছে এবং যা শুনেছে হুবহু তা মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছে।[10] হযরত আবু উমামা রা. বর্ণনা করেন, নবীজী (সা)এর নিকট দুই ব্যক্তির আলোচনা করা হল। তাদের একজন ছিল আলেম অপরজন আবেদ। তখন নবীজী (সা) ইরশাদ করলেন- আবেদের (আলেম নয় এমন ইবাদাতগুযার নেককার ব্যক্তির) উপর আলেমের মর্যাদা তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদার ন্যায়।[11] রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেনঃ ‘পূর্ণিমার রাতে নক্ষত্রমালার উপর পূর্ণ চন্দ্রের যেরূপ মর্যাদা, আবিদের উপর আলিমের মর্যাদা ঠিক তদ্রূপ।’[12] রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- কেউ যখন কাউকে কোনো ভালো কাজের পথ দেখিয়ে দেয়, সে ব্যক্তি কাজটি করে যে সওয়াব পাবে, যে তাকে এর পথ দেখিয়ে দিল সেও অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে।[13] মুয়াবিয়া (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘‘মহান আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তিনি তাকে দীনি গভীর ‘ইলম’ দান করেন।’[14] আবুদ্দারদা (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হয় আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার সম্মানে নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেয়। আলেমের জন্য আসমান-জমিনের সবাই দু‘আ করতে থাকে। এমনকি সাগর ও খাল-বিলের মাছও তার জন্য দু‘আ করতে থাকে। আবেদের ওপর আলেমের মর্যাদা তেমন, যেমন নক্ষত্ররাজির ওপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা। আলেমগণ হলেন নবীগণের ওয়ারিছ। আর নবীগণ ধনসম্পদের মীরাছ রেখে যান না, বরং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ইলমের মীরাছ রেখে যান। সুতরাং যে ব্যক্তি এই মহামূল্যবান মীরাছ গ্রহণ করল সে বিরাট মূল্যবান বস্তু গ্রহণ করল।’[15] বস্তুত: শিক্ষক হলেন জ্ঞানের সমুদ্র। সেই সমুদ্র থেকে শিক্ষার্থীরা মনি-মুক্তা সংগ্রহ করে। আগামী শনিবার ০৫ অক্টোবর-২০২৪, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সারা বিশ্বের সকল শিক্ষকের জন্য মহান আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও নেক হায়াত কামনা করছি, আমীন।
[1] সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩১-৩২।
[2] সূরা ফাতির, আয়াত: ২৮।
[3] সূরা যুমার, আয়াত: ৯।
[4] সূরা আলে-ইমরান, আয়াত:১৯০]।
[5] সূরা আর-রুম, আয়াত: ২২।
[6] সূরা মুজাদালাহ, আয়াত: ১১।
[7] সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত : ২৬৯।
[8] সুনানে ইবনু মাজাহ হা/২২৯; ছহীহাহ হা/৩৫৯৩।
[9] জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৫, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৫২।
[10] সুনানে তিরমিযী ২৬৫৮, মুসনাদে শাফি‘ঈ ১৬।
[11] জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৫।
[12] সুনানে তিরমিযী: ২৬৮৫, সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২১২ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[13] সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৩১।
[14] সহিহ বুখারি: ৭১, সহিহ মুসলিম: ১০৩৭।
[15] সুনানে আবূ দাউদ ৩৬৪১,সুনানে দারেমী ৩৪২ ,সুনানে ইবনু মাজাহ: ২২৩; সহীহ |