বিপ্লবের স্বপ্ন ও বাস্তবতা: কেন টিকে থাকে না পরিবর্তনের ঢেউ?

বিপ্লব একটি জাতির ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। এটি শোষণ, অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ। তবে ইতিহাস বলে, বেশিরভাগ বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিপ্লবের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন হলেও, সময়ের সঙ্গে বিপ্লবের মূল চেতনা হারিয়ে যায়। নতুন শাসকরাও অনেক সময় পূর্ববর্তী শাসকদের মতো আচরণ করতে শুরু করে। প্রশ্ন হলো— কেন বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হয় না? কীভাবে একটি বিপ্লবকে স্থায়ী করা যায়?
বিপ্লব কেন দীর্ঘস্থায়ী হয় না?
১. নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি
প্রাথমিকভাবে বিপ্লবের নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ থাকে, কিন্তু ক্ষমতা দখলের পরই বিভক্তি শুরু হয়। বিপ্লবের নীতির পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে, ফলে বিপ্লব দুর্বল হয়ে পড়ে।
উদাহরণ:
ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) : রাজতন্ত্র পতনের পর জ্যাকোবিন ও জিরোদিনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রবেস্পিয়ের ক্ষমতায় এলে তার সন্ত্রাসী শাসন জনগণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে, যা বিপ্লবের আদর্শকে দুর্বল করে দেয়।
রুশ বিপ্লব (১৯১৭) : লেনিনের মৃত্যুর পর বলশেভিক দলের মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা পরবর্তীতে ট্রটস্কির নির্বাসন ও স্তালিনের স্বৈরশাসনের জন্ম দেয়।
২. গণমানুষের সম্পৃক্ততার অভাব
একটি বিপ্লব তখনই সফল হয়, যখন জনগণ এতে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যদি বিপ্লবী সরকার জনগণের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের সমর্থন হারিয়ে যায়।
উদাহরণ:
আরব বসন্ত (২০১০-২০১১) : স্বৈরশাসকদের পতনের পর নতুন সরকারগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, ফলে আবার স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসে।
৩. প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা
বিপ্লবের পর নতুন সরকার যদি সুশাসন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে না পারে, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ:
লিবিয়া (২০১১) : গাদ্দাফির পতনের পর দেশটিতে কার্যকর সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে, ফলে দেশটি প্রায় অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
৪. বহিরাগত হস্তক্ষেপ
আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো অনেক সময় বিপ্লবী দেশকে দুর্বল করার চেষ্টা করে, যাতে তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে।
উদাহরণ:
চিলির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯৭০-১৯৭৩) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী নীতির কারণে সিআইএ সালভাদোর আলেন্দের সরকারকে উৎখাত করে এবং স্বৈরশাসক পিনোশেকে ক্ষমতায় বসায়।
৫. আদর্শের পরিবর্তন ও দুর্নীতি
বিপ্লব সাধারণত আদর্শগত কারণে সংঘটিত হয়। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় গেলে, অনেক সময় আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে ওঠে।
উদাহরণ:
নেপোলিয়নের উত্থান (ফরাসি বিপ্লবের পর) : গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লব শুরু হলেও, নেপোলিয়ন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু করেন।
কীভাবে বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী করা যায়?
১. শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গঠন
নেতৃত্বের মধ্যে বিভক্তি দূর করে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে।
৩. প্রশাসনিক দক্ষতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
একটি কার্যকর প্রশাসন ও শক্তিশালী অর্থনীতি ছাড়া বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
৪. বহিরাগত হস্তক্ষেপ এড়ানো
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সঠিক কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে হবে।
৫. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
নাগরিকদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন করা জরুরি, যাতে তারা বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ভুলে না যায়।
উপসংহার
বিপ্লব তখনই সফল হয়, যখন এটি শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, বরং সমাজে স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। ইতিহাসের শিক্ষা হলো— নেতৃত্বের বিভক্তি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, জনসম্পৃক্ততার অভাব ও বহিরাগত হস্তক্ষেপ বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। তাই একটি বিপ্লবের চেতনা টিকিয়ে রাখতে হলে জ
নগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ও কার্যকর করতে হবে।