ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্ব ও রাজনৈতিক অনাচারকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়

Dec 27, 2024 - 00:30
Dec 27, 2024 - 00:48
 7  40
ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্ব ও রাজনৈতিক অনাচারকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়
ছবি এডিটঃ সম্পা রানী সরকার

প্রত্যেক সমাজের সংখ্যালঘুদের মতো বাংলাদশেরও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষ কিছু সমস্যা আছে, অব্যক্ত কিছু দুঃখ ও বেদনা আছে। জানা থাকলেও সংখ্যাগুরুদের সবাই তা উপলব্ধি করতে পারে না। উপলব্ধি করার মতো মন থাকতে হয়, মেধাও থাকতে হয় যা সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই থাকে না।

আমার গ্রামে একটিমাত্র হিন্দু পাড়া আছে। আমাদের অন্যপাড়ার গ্রামবাসীর সাথে যেমন সম্পর্ক এদের সাথেও তেমনিই সম্পর্ক। অনেকের মতো ওরাও গরীব। আমার ঘনিষ্ট সহপাঠি ও পাঁচ বছরের স্কুলের যাতায়াতের সাথীটি ছিল এ পড়াতেই। সেই সুবাদে অন্যান্যদের চেয়ে এ পাড়ার গ্রামবাসীর সাথে আমার হৃদ্যতা অনেক বেশি। আমি তাদের ঘরের ছেলেই বটে। আমিও তাদের পর মনে করি না। 

গত ৫ জুলাইয়ের পর হিন্দু পাড়া থেকে আমাকে জানাল যে কারা যেন গুজব ছড়াচ্ছে যে সেখানে হামলা হবে। আমি স্থানীয় থানায় জানালাম। ফেইসবুকে স্টাটাস দিলাম। অন্যসব পাড়া থেকে বহুলোক দ্রুত হিন্দু পাড়ায় গিয়ে উপস্থিত হল। সবাইকে অভয় দিল। এখনও তারা অভয় নিয়েই আছে।

কিন্তু বাংলাদেশের সব স্থানের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক যে আমাদের এলাকার মতোই তা নয়। অনেক স্থানে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে তা পত্রিকার শিরোনাও হচ্ছে। তবে তাই বলে যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নিত্যদিনই নির্যাতিত হয়, তাও নয়।  ভারত উপমহাদেশের সব অঞ্চলের মতোই বাংলাদেশেও ইতোপূর্বে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে। এসব দাঙ্গার কোথাও কোথাও সঠিক কারণও ছিল। কিন্তু যেসব স্থানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল সেসব স্থানেও তার ঢেউ লেগেছিল। তবে দাঙ্গার জন্য দায়ীরা সবক্ষেত্রেই সমাজের উঁচুতলার লোক। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরিদ্ররাই। ধনীরা আত্মগোপন করতে পারে, অন্যস্থানে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু দরিদ্রদের যাবার অন্য কোন স্থান নেই। এটা দুই সম্প্রদায়েরই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সত্য। ১৯৪৬ সালের কোলকাতার দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানী হয়েছিল বস্তিগুলোতে। উঁচুতলার লোকজন প্রান্তিক মানুষগুলোকে উসকে দিয়ে নিজেদের আয় রোজগার বাড়িয়ে নেয়, নেতৃত্ব পাকাপোক্ত করে।

দেশের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারীর অভাব নেই।  চরমপন্থীরা এর সুযোগ গ্রহণ করছে যেটা তারা আগেও করেছে। তবে আমাদের সমাজ, সরকার ও দায়িত্বশীলগণ এ বিষয়ে সচেতন আছে। সাধ্যমত সবাই যার যার অবস্থান থেকে  কিছু না কিছু করছে।

আমাদের অবস্থা আমাদের চেয়ে কে বেশি জানে, বোঝে? বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাস না করেও কেউ যদি দাবী করে বাংলাদেশ টিকবে না, তবে তার দাবীকে পাত্তা দিবে কে? পশ্চিম বাংলার ঐ ভাঁড়টি যে নিজের চ্যানেলের ভিউ বাড়ানো, ও নিয়োগকারীদের খুশী করার জন্যই এত কিছু করছে তা  বুঝতে কি কারো অসুবিধা হয়? 

বাংলাদেশ এখন একটি বিশেষ অবস্থা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে কিছু ধর্মীয় চরমপন্থীর বাড়াবাড়ি অবশ্যই আছে। মুসলমানদেরই এক ফেরকা কর্তৃক অন্য ফেরকাদের মাজারসহ ঘরবাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত পনের বছর যারা এদেশের মানুষের উপর স্টিম রোলার চালিয়েছিল তাদের ও তাদের সহযোগিরা যে রোষের শিকার হবে, সেটা তো যে কোন বিপ্লব গণঅভ্যূত্থানের পরেই হয়ে থাকে সেটা তো সবার বোঝার কথা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও তৃণমূলের নাগরিকদের নিরাপত্তাদানকারী পুলিশ বাহিনীর কি দুরবস্থা হয়েছিল সেটা তো সবারই জানার কথা। ১৯৭১ সালে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনও বাংলাদেশের কোন পুলিশ স্থাপনা, বিশেষ করে থানার দুয়ার বন্ধ হয়নি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ জুলাইয়ের পর তা হয়েছিল। এমতাবস্থায়, স্বৈরাচার ও তাদের পলাতক দোষরদের বাড়িঘরের পূর্ণ নিরাপত্তা সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি। বস্তুত ৫ আগস্টে স্বৈরাচারী সরকারের পলায়নের পর অন্তর্বতীকালীন সরকারের শপথ গ্রহেণর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন সরকারই ছিল না বলে ধরে নেয়া যায়। প্রাণ নিয়ে পলায়ন করা পুলিশ কিভাবে নিরাপত্তা দেবে দেশবাসীর! তাই দেশবাসী নিজেরাই সে দায়িত্ব পালন করেছিল। ছাত্ররা পালাক্রমে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থান ও বাসাবাড়ি পাহারা দিয়েছিল। কিন্তু  তাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল।

   এসময় স্বৈরাচারের মুসলিম দোসরদের সাথে সাথে অমুসলিম দোসরদেরও জনতার ক্ষোভের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। সরকার পতনের পর স্বৈরাচারের মুসলিম সহযোগীরা যেমন সবকিছু ছেড়ে পলাতক হয়েছে, তেমনি হিন্দু সহযোগীরাও। এখানে কোন ধর্মীয় বিবেচনা কাজ করেনি। অথচ স্বার্থান্বেষীরা এ ক্ষোভের শিকারদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বের আবরণে মোড়ানোর চেষ্টা করছে। যারা পুলিশসহ গোটা প্রশাসনকে পারিবারিক উপনিবেশ বানিয়েছিল, তারাই এখন পুলিশের দুরবস্থার জন্য অশ্রুপাত করছে।

তাই ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সেই প্রচারণাকে প্রতিহত করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, যারা আমাদের এ অবস্থান জন্য দায়ী তারা কিন্তু এখন নিরাপদেই আছে। কেউ কেউ বিদেশী সরকারের  আশ্রয়ে কেউ বা সুইজারল্যান্ড, কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি সুখের ঠিকানায় রয়েছে। অথচ তাদের অপকর্মের দায় নিয়ে ভুগতে হচ্ছে নিরীহ কর্মীদের। গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিতে সকল ধর্মের মানুষই জড়িত আছে। তাই রাজনৈতিক দুরবস্থা ও সু-অবস্থার ভাগিদার সবাইকেই হতে হবে।

আমাদের অমুসলিম ভাইদের দেশপ্রেমে যারা সন্দেহ করে আমি তাদেরই দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করি। দেশপ্রেম অন্তরের জিনিস যার আচরণিক বহিঃপ্রকাশ সবার কাছে সমান নয়। বাহ্যিক আচরণকে পরিমাপ করা যায়, কিন্তু মনকে বোঝার বিজ্ঞান এখনও অপরিপক্ক।

 সংখ্যালঘুদের মনের দুঃখ উপলব্ধি না করে তাদের দেশপ্রেমে সন্দেহ করা বিদ্রুপাত্মক। সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেমে সন্দেহ করা আর সংখ্যাগুরুদের ধর্মবিশ্বাসে সন্দেহ করা সমানভাবে আপত্তিকর।

একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বা যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নিয়ে যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি হওয়া যায়, মহান সংসদের সদস্য হওয়া যায়, মন্ত্রী সভার সদস্য হওয়া যায়, কই তাদের দেশপ্রেম নিয়ে তো সোসাল মিডিয়া সরগম হয়নি? ‘হৃদয় মাঝে কাবা, নয়নে মদিনা’ থাকলে সংখ্যাগুরুদের দেশপ্রেমে ঘাটতি না হলে, মনের মধ্যে কাশি-গয়া থাকলে তাদের দেশপ্রেম কমে কিসে? সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেমে সন্দেহ করা আর সংখ্যাগুরুদের ধর্মবিশ্বাসে সন্দেহ করা সমানভাবে আপত্তিকর।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।