মা
বড় রাস্তা ধরে মণ্ডপচরা। আদিবাসী সম্প্রদায়ের পবিত্র স্থান।সে পথ ধরে একটু দূরে দুপাশে ঘন বাঁশঝাড়।দিনের বেলায় গা ছমছম ভাব,পথিক মনে ভূতের ভয় আনে। সন্ধ্যায় বেশি। দুপাশে দশ-বারোটি বাড়ি নিয়ে ইপুচি পাড়া স্তিমিত আঁধারে বিষণ্ণ নারীর মত উদাসী।এই এলাকার ভূ-পতি ডোমেন সরকারের তিনশ বিঘা জমি ছিল।১৯৬৫ সালে বিনিময় করে ইন্ডিয়ায় চলে যায়।তখন যারা এসেছে(রিফিউজ) ইপুচি নামে পরিচয় পায়। রাস্তার পূর্ব পাশে বড় বড় টিনের দুটো বাড়ি।গাছঘেরা বাড়ি দুটোতে সুখ আর সমৃদ্ধি।গোয়ালে দুধেল গাই, ছাগলের পরম্পরা প্রজন্ম বৃদ্ধি,পুকুর ভরা মাছ আর শস্য -সবজির ঘনিষ্ঠ নিবিড়তা দেখে অভাব দূরে কাঁদে।একটি বড় ইন্দিরার মাঝে টিনের পাটিশন দুটো বাড়িকে মিলিয়ে দিয়েছে। কাঁচা মিঠা আমগাছটিও মায়ের মত সমান মায়া আর ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। সামনে বাগান, পুকুর আর ফসলী সবুজ জমি তারুণ্যে চকচক করে।দু বাড়ির দশ বারোটি ছেলে মেয়ের উচ্ছ্বলতা, খেলাধুলা, যত্ন-ভালোবাসার অবাধ্য হৈচৈ শুনশান নীরবতা ভেঙে, পাড়াকে হাস্যময়ী করে।সে বাড়ির একটি মেয়ে, বখাটে ছেলের চুলের মত চুল, হলুদ দাঁত আর পেত্নীর মত ধারালো নখের ফর্সা, স্বাস্থ্যবতী আবেদনময়ী দিবা অন্ধকারে এক ভয়ঙ্কর রহস্য ছড়ায়। চটের মত মোটা গাউন পড়া ২০-২২ বছরের মেয়েটিকে পথচারী প্রায় সকলের চেনা। মায়েদের শিশু বশীভূতকরণের একটি নাম এই রহস্যময়ী।
প্রচণ্ড ক্ষুধায় সে অপেক্ষা করে বাড়ির মানুষের খেতে বসার মুহূর্তের।অন্য সদস্যদের তৃপ্তির আহারের সুখ থাকলেও তার জন্য নির্ধারিত ভাগই বরাদ্দ।তাই ক্ষুধা না মেটায় অন্যদের মাটিতে পড়া উচ্ছিষ্ট শিকারী চিলের মত ছোঁ মেরে তুলে মুখে দেয়।
বাঁচার দুমুঠো ভাত জুটলেও, সমাজের এমন অপ্রয়োজনীয় মানুষটির জন্য নেই শোবার ঘর,নেই যত্নে করা বিছানা। বারান্দার একপাশে মাটিতে,কখনও ছেঁড়া পাটিতে ষড়ঋতুর মিশ্রিত অনুভবে গুটিসুটি কাটে তার জীবন-বেদনার রাত।
তার জন্মানোর সময়ের নামটিও সবার মন থেকে মুছে গেছে সময়ের সহনীয় প্রবহমানতায়।একদিন গরমের রাতে পুকুরের জলে এক অদ্ভুত জন্তুর মত দৃশ্য চোখে পড়ে।তখন গ্রামে এক নূতন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে"খিনশালি"।আলো-আঁধারিতে,দেখা-অদেখা কল্পনার এক অদ্ভুত জন্তু সে সময় মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।যে শব্দটির অস্তিত্ব অজানা সেটিই সংস্কারের মতো মানুষের প্রবল বিশ্বাসে গেঁথে যায়।এই গুজবী জন্তুর সাক্ষাত হয়তো কখনো কারো মেলেনি। তবু পুকুরের জলে 'খিনশালির'অদৃশ্য আতঙ্কে এক সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা আঁধারে সবাই লাঠিসোটা,সড়কি নিয়ে মারতে যায়। এমন সময় কোমলপ্রাণা একজন প্রতিবেশী চিৎকার করে বলে দাঁড়াও,মেরো না।সে আবার চিৎকার করে আছমা! আছমা! জলের নির্জনতা ভেঙে শব্দ আসে কী? প্রতিধ্বনি হয় কী!কী! নিজের নাম শোনার অভ্যাস না থাকলেও নামটি ভোলেনি এতকাল মেয়েটি ...
তার চেনা পৃথিবীতে কথা বলার কেউ না থাকলেও ভিতর দরজায় বাঁশের কঞ্চি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে "মা"! সৎমা
!