নিরুত্তর প্রশ্ন বিভ্রম

সপ্ততি বিধবা বর্ষিয়সী বাবার ভিটেয় ভাতিজাদের ঘরে বেশ আধিপত্যের সাথে বাস করে।সবাই তাকে মাথায় করে রাখে। দুই দুয়ারী বড় বাড়িতে প্রয়োজনে তরকারি কাটা,চাল বাছা,শাকতোলা এমন ছোট ছোট কাজে নিজেকে যুক্ত রাখে। আবার কখনও সৌখিন কাঁথার ফোঁড়ে লুকিয়ে রাখে হারানো মধুর অতীত।
আপনজনের ভালোবাসায় ধন্যা এই বৃদ্ধা প্রতিরাতের গল্পদাদি। নাম চিনি।কেউ ডাকে চিনি বেটি,চিনি ফুবু,কেউ চিনি বুবু, চিনি বু,চিনি দাদি।ডাকের বৈচিত্র্য ছাড়িয়ে চিনির মত মিষ্টি তার ব্যবহার এবং কিচ্ছা কথন।শুনতে শুনতে রাত কখনও গড়িয়ে যায় ভোরের দিকে। তবু আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়।
দেখতে মাঝারি গড়নের,একটু সামনে নুয়ে পড়া,মাথা ভর্তি সাদা চুল।আর সাদা অরণ্যে উকুনের নির্বিঘ্নে বসত। মেলানিনশূন্য চুলে উকুনও ডিটারজেন্ট পাউডারের শক্তির মত আশ্চর্য সাদা।একদল নাতি-নাতনি বানর রাজা, পঙ্খিরাজ, রাজকুমার, কিংবা ডাইনির সম্মোহনে সাদা অরণ্য চষে খোঁজে বহিঃপরজীবী পোকা।আর বন্ধ চোখের প্রশান্তিতে বাড়তে থাকে চিনিদাদির ঝুলিতে রাক্ষস খোক্ষস, দেও-দানব। সন্ধ্যায় কুপির আলোয় খোলা বারান্দায় পাঁচ ঘরের নাতি-নাতনির সুর-বেসুরো পুঁথিপাঠের মত স্কুলের পাঠ মুখস্থের ঝঙ্কারে চিনি দাদি বারান্দার এক পাশে অনাবশ্যক বিছানায় আয়েশি হেলান দিয়ে সবার মনোযোগ তদারকি করে।
রাতে অনুমানে আঁকা রম্বসের মত একটি লম্বা ঘরে দুধারের বড় চৌকিতে লাইন করে শোয় সম-অসম সব শিশুর দল।কল্পদেশের গল্পকথনে রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ঘরটি হয়ে উঠে বিমোহিত রূপকথা।জীন-পরি,সাপ-ভালুক,রাজা-রানী সব বেরিয়ে আসে বৃদ্ধার গোপন ঝুলি থেকে।
চিনি দাদির সাথে সখ্য জ্বিনের। শেষ ভোরে ওদের ডাকে আম কুড়াতে যায়।কোছা ভরা আমের ভিতর দেখে মাটির ঢেলার প্রলোভন। আবার ক্ষয়িত সাঁঝের আবছায়ায় সরিষার তেলে ফুলে উঠা পাকান পিঠার স্বাদগন্ধে চলে আসে ওরা দু-চারজন।দু-একটি পিঠা পেয়ে অতৃপ্ত ওরা আবার আসে। একান্নবর্তী সদস্যদের খাবার তৈরির ধৈর্যচ্যূতি ঘটায় স্বাভাবিক ম্যানার না জানা এসব ভিন্ন শরীরী অশরীরীরা!তখন লোহার শিল আগুনে পুড়িয়ে ওদের বাড়ানো হাতে দিলে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়।
কারো কারো সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা দাদির। মাঝে মাঝে ঘরে আলো দেখা যায়। আবার দাদি রাতের দীর্ঘ ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলে সেই জীন নাকি বাকি গল্প শেষ করে। এভাবে যখন তখন নিয়ম না মানা আবির্ভাব শিশুদের ভয়ের কারণই নয়, বড়দেরও আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়।
একদিন তান্ত্রিক কবিরাজ এল। পুরো বাড়ি পর্যবেক্ষণ করে বাড়ি বন্ধ করতে দুটো সাদা কুকুরকে রুটি মাংসে তৃপ্ত করে এক কোপে মাথা কেটে দুই দুয়ারে পুঁতে রাখার পরামর্শ দেয়। অনেক কষ্টে মিলে জোড়া কুকুরের সদ্য কাটা মাথা। সাথে বন্ধ হয় অযাচিত অশরীরী গমন। চিনি বুবুও ঝিমিয়ে যায়। গল্পনেশায় থাকে না চমক।অকারণ তাকিয়ে থাকে ঘন বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে কড়ই গাছ পেরিয়ে আঁধারে..
কৌতূহলি নাতি-নাতনির স্পষ্ট প্রশ্ন দাদি জিন সত্যিই আগুনের তৈরি?দাদি নীরব সম্মতি দেয়। 'আগুনের হাতে আগুন শিল',ওরা পালায় কেন? স্তব্ধ,নির্বাক চিনি দাদি ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকে নিরুত্তর প্রশ্ন বিভ্রমে দূরে...