প্রশ্ন করার গুরুত্ব ও কিছু উপলব্ধি

এক নিস্তব্ধ-নির্লিপ্ত দুপুরে ইংল্যান্ডের উলসথর্প ম্যানরের বাগানে এক আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় নিউটন আঙ্কেল। এমন সময় সেই গাছ থেকে এক আপেল তার মাথার উপর পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আপেল ঘাতে চকিত হয়ে নিউটন নিজেকে প্রশ্ন করলেন, কেন এমনটি হলো? আপেলটি নিচে না পড়ে উপরের দিকে উঠে গেল না কেন? এসকল প্রশ্ন থেকেই তিনি একসময় আবিষ্কার করে ফেললেন তাঁর জগদ্বিখ্যাত মহাকর্ষের সূত্রটি, যা আগামী কয়েক শতাব্দীতে বদলে ফেলল সারা দুনিয়ার চিত্রপট। প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা, এমন এক ধরনের বাক্য যা মানুষের কৌতুহলকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে তার উত্তর জানতে চায়। সভ্যতার একেবারে শুরুর কথা যদি চিন্তা করি মানবসভ্যতার বিস্তার ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে একটি কারণে আর সেটি হলো প্রশ্ন। আল্লাহ তায়ালা অন্যান্য প্রাণিকূলের তুলনায় মানুষকে যে অনন্য বৈশিষ্টটি দিয়েছেন তা হলো চিন্তা করার ক্ষমতা। প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা ও উপাদানে কৌতূহলী হওয়া মানুষকে প্রদানকৃত স্বাভাবিক বৈশিষ্ট। মানুষের এই স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যই তাকে প্রকৃতই সম্পর্কে জিজ্ঞাসু তৈরি করে, মনের মাঝে তৈরি হয় নানা ধরনের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মানুষ সমাধান করে মহাবিশ্বের অজানা জটিল সব রহস্য। উদ্ভাবন করে অকল্পনীয় সব প্রযুক্তি। এগিয়ে চলে সভ্যতা, এই প্রশ্ন করার প্রবণতার কল্যাণে আদিম প্রস্তর, লৌহ, তাম্র সকল যুগ পেরিয়ে আমরা আজ এসে পৌঁছেছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহা-বিপ্লবীক আধুনিক-উত্তর বা পোস্ট-মর্ডানিটির যুগে।
অর্থাৎ প্রশ্ন করা আমাদের অস্তিত্বের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। শুধু প্রকৃতি বিষয়ে কৌতূহল মেটানোর জন্যই নয়, আধুনিক সমাজের নানাবিধ সমস্যার সমাধানেও প্রশ্ন করা একটি অনস্বীকার্য মাধ্যম। একটা থিওরি প্রচলিত আছে যে যদি টেকসই সমাজ গড়তে চাও তাহলে শতকরা ৮০% সময় ব্যয় করো প্রশ্ন-উত্তরে আর বাকি ২০% ব্যয় করো গড়তে। প্রশ্ন করার মাধ্যমে যে জবাবদিহিতার পরিবেশ গড়ে ওঠে তা উন্নত ন্যায়ভিত্তিক সমাজের ভিত্তিমূলরূপে কাজ করে। কোনো বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হলে প্রথম ধাপে বিষয়টির উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি করে নিতে হয় এবং সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা যায়। এই প্রবন্ধটি লেখার সময়ও নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে হয়েছে। একটি শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার ধারণার বাহিরে ইহ্জগতের অসংখ্য বিষয়ে প্রশ্ন করার মাধ্যমে জানতে পারে। শিশুরা সাধারণত বিশ্ব সম্পর্কে শিখতে শুরু করে শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করে আর সেটা হলো “কেন”। তাই শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য প্রশ্ন করা এবং তার উত্তর দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নচেৎ শিশু কোনো বিষয়ে ভুল ও বিকৃত ধারণা পেয়ে তার বিপথে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিষয়টি কেবল শিশুর জন্যই প্রযোজ্য নয়, কোনো বিষয়ে অসত্য ধারণা এবং অপর্যাপ্ত তথ্য একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষকেও ক্রুটিপূর্ণ এমনকি ধ্বংসাত্মক পথে পরিচালিত করতে পারে। তাই সর্বদা প্রশ্ন করার মাধ্যমে সত্য জানার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অনেক সময় কৌতূহল বিভ্রান্তিতে রূপ নেয়। প্রশ্ন হলো তথ্য জানার ইনপুট। যেখানে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে সেখানে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। জীবনের যেকোনো বিষয়ে অপর্যাপ্ত ও বিভ্রান্তিপূর্ণ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কথায় আছে, অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। তাই মনের সকল বিভ্রান্তি দূর করতে বেশি বেশি প্রশ্ন করতে হবে। তবে প্রশ্নটি উক্ত বিষয়ের কোনো বিদ্বান, বিবেক ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে করা হলে তার তাৎক্ষণিক ও কার্যকরী ফলাফল পাওয়া সম্ভব। অপরদিকে কোনো স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, বিবেকহীন এবং অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে উক্ত বিষয়ে প্রশ্ন করলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাংলাদেশের অত্যন্ত গুণি একজন শিক্ষাবিদ ড. ইউসুফ এম ইসলাম তার প্রশ্নের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক একটি প্রবন্ধে উল্ল্যেখ করেছেন, “একজন মানুষ লিখতে পড়তে না পারলেও জ্ঞান অর্জনে কোন সমস্যা হবে না যদি সে প্রশ্ন করার অভ্যাস সাথে নিয়ে চলতে পারে।” প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের মাঝেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ববোধ কাজ করে। ‘প্রশ্নটি করা ঠিক হবে কিনা?’, ‘প্রশ্নটি মানানসই হবে কিনা?‘ প্রশ্নটি শুনে সবাই হাসাহাসি করবে কিনা?’ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ক্ষেত্রে এরূপ নানা প্রকার ভয় আমাদের মাঝে কাজ করে। অনেকে বেশি প্রশ্ন করাকে বোকামির সামিল মনে করেন। হ্যাঁ, প্রশ্ন করার ফলে কোনো কোনো সময়ে অপ্রতিভ ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এটা সত্য। তবে প্রশ্ন করার প্রভূত উপকারিতা এই বিব্রতবোধকেও ছাড়িয়ে যায়। চীনদেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে "যিনি প্রশ্ন করেন তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য বোকা থাকেন; আর যিনি প্রশ্ন করেন না তিনি চিরদিনের জন্য বোকা থাকেন "। তাই প্রশ্নকারীকে বিব্রত করা অত্যন্ত অনুচিত। আবার একই প্রশ্ন একাধিক ব্যক্তির মাথায় ঘুরপাক খেতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি যদি সাহস করে প্রশ্নটি করে তাহলে অন্যরা সবাই উপকৃত হবে। আবার একটি প্রশ্নের উত্তর প্রাপ্তির পর সে বিষয়ে আরও নতুন নতুন প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। খুলে যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন সব দিক। তৈরি হতে পারে নতুন নতুন সম্ভাবনা।
পৃথিবীতে আমরা কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমরা সবাই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আমরা কেউই সম্পূরক জ্ঞান ও বিবেকের অধিকারী নই। জীবনে চলার পথে আমাদের অজস্র সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এই সমস্যাগুলোর সমাধান আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বিদ্যমান। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমাদের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য-অগণিত তথ্যের ভাণ্ডার। ব্যক্তি ও প্রযুক্তির মাঝে সঞ্চিত এই স্তূপীকৃত তথ্য আমাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানে সহায়ক। এই সকল তথ্য ও সমাধান আহরণে যা প্রয়োজন তা হলো প্রশ্ন করা, জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আমাদের প্রশ্নের মান যত উন্নত হবে আমাদের জীবনযাত্রার মানও তত বেশি উন্নত হবে। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা যেন প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে ভীত ও দ্বিধাগ্রস্ত না হয় সেই পরিবেশ তৈরি করা হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশ্ন করার এই অভ্যাস তাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা করে। উদ্ভাবনের উপর যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানিয় বক্তা পল স্লোণি বলেছেন, “উদ্ভাবনী চিন্তাবিদদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস হচ্ছে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা”।
ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ, প্রকৃতি ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে অজানা ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে প্রশ্ন করতে হবে। আইসিটির এই যুগে এই কাজ অন্য সকল সময়ের চেয়ে আরও সহজ। শুধু থাকতে হবে একটু চেষ্টা ও ইচ্ছাশক্তি। প্রশ্ন করতে হবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে। নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করতে হবে। প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শালীনতা বজায় রাখতে হবে। তর্ক ও বিব্রত করার অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন করার চেয়ে জানার আগ্রহ ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করা অধিক কার্যকরী। নতুন নতুন প্রশ্ন তৈরি সেগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের সাহায্য নিতে হবে। প্রশ্ন শুধু নিজের মধ্যে চেপে না রেখে অন্যের সাথে তা বিনিময় করতে হবে। এর ফলে আরও দ্রুত কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়া যায়। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। প্রশ্নে নতুনত্ব আনয়নের চেষ্টা করতে হবে। অতঃপর নির্দিষ্ট গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে তার উত্তর নিরূপণ ও অনুধাবন করতে হবে। নিজের কোনো উত্তর অজানা থাকলে কেবল নিছক মান রক্ষার উদ্যেশ্যে মনগড়া উত্তর দেওয়া যাবেনা, সরাসরি সে বিষয়ে নিজের অপারগতা প্রকাশতা প্রকাশ করতে হবে। প্রশ্ন করার যথার্থ অধিকার ও সুযোগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এর ফলে নতুন কিছু উদ্ভাবন করার চিন্তা ও আগ্রহ তৈরি হবে। প্রশ্নকে দমিয়ে রাখা যাবেনা, তাতে অকল্যাণ বৃদ্ধি পায়। ইচ্ছাপূর্বকভাবে কিংবা বিব্রত করার উদ্দেশ্যে উদ্ভট ও অসংলগ্ন প্রশ্ন করা যাবে। প্রশ্ন হওয়া উচিত গঠনমূলক ও বস্তুনিষ্ঠ। বিশেষ পরিস্থিতি ও প্রয়োজন ব্যতীত কারও পারিবারিক ও ব্যক্তিগত গোপন বিষয় জিজ্ঞাসা করা যাবে না। কারও প্রশ্নকে পূর্ণ অনুধাবন করা ছাড়াই উদ্ভট বলে গন্য করা যাবে না। কেউ উদ্ভট প্রশ্ন করে ফেললে তাকে ধমক দেওয়া যাবেনা, বিষয়টির অসংলগ্নতা তাকে উত্তমরূপে বোঝাতে হবে, যেন পরবর্তীতে প্রশ্ন করতে তার মনে ভয় ও দ্বিধার সৃষ্টি না হয়। ইন্টারনেটে বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে যেখানে মুক্তভাবে যেকোনো প্রশ্ন করা যায়। এসব মাধ্যমে রয়েছে নানাবিধ আকর্ষণীয়, ভিন্নধর্মী এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রশ্নের সমাহার। বিভিন্ন ব্যক্তি সেসব প্রশ্নের গঠনমূলক উত্তর প্রদান করে থাকেন। প্রশ্নের উত্তর জানার ক্ষেত্রে এ ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, নিজ প্রচেষ্টায় প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই। নিজের কৌতূহল বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্ভাবন ও গবেষণার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে নিজ প্রচেষ্টা এবং অপরের সহায়তায় সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা তথা জবাবদিহিতার মাধ্যমে ন্যায় ও সুষমতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যার ফলাফলে সমাজ ও দেশের উন্নতি পৌঁছে যাবে এক অনন্য মাত্রায়।