বাঙালি নারীর অলঙ্কার-ব্যবচ্ছেদ

ছোটোকালে সন্ধি বিচ্ছেদ করতাম : অলম+কার= অলঙ্কার। কিন্তু সে সময় এর চেয়ে বেশি কিছু জানার আগ্রহ ছিল না। বারংবার পড়ে মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে পূর্ণ নম্বর পাওয়ার বাইরে সন্ধি নিয়ে আর মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু পরিণত বয়সে পড়ার অভ্যাসটা যখন পরিপূর্ণই রয়েছে , তখন অলম+কার-এর নাড়ি-নক্ষত্র মনের অজান্তেই জানা হয়ে গেল।
বাঙালি মেয়েদের গহনাপ্রীতির কাহিনি কে না জানে? ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এমনকি স্রেফ সাহিত্যকর্মেও বাঙালি নারীর অলঙ্কারপ্রীতির প্রভূত কাহিনি রচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ নামের ছোটোগল্পে দেখা যায়, যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তা রমণী ‘ক্ষীরোদা’ যার ফাঁসি একদিন পরই কার্যকর হবে, সেও খোয়া যাওয়া স্বর্ণের আংটির জন্য জেলখানার বাগানের প্রহরীর সাথে উচ্চৈস্বরে ঝগড়ায় অবতীর্ণ হয়েছে।
খেটে খাওয়া সাধারণ নারীদের কাছে অকল্পনীয় হলেও অভিজাত বাঙালি মেয়েদের সারা শরীর মোড়ানো থাকত অলঙ্কারে। নাক ও কানের অলঙ্কার পরতে হতো এ দুটো অঙ্গ ফুটো করে। জনৈক ইউরোপীয় মহিলার ডায়েরির পাতা থেকে জানা যায়, একজন বাঙালি নারীর নাক ও কানে অলঙ্কার পরার জন্য অন্তত পঞ্চাশটি ছিদ্র থাকত। আর ষোলো বছর বয়সী এক বালিকা বধুর শরীরেও চড়ান হতো প্রায় ২৫ সের ওজনের গহনা।
কিন্তু এ অলঙ্কার শব্দটি আসলো কীভাবে? সন্ধি বিচ্ছেদের সময় অবশ্য এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে, ‘অলংকার শব্দটির বুৎপত্তি ঘটেছে ‘আলম’ শব্দ থেকে। আলম উৎপন্ন হয়েছে বৈদিক শব্দ অরম থেকে, যার অর্থ ‘ঠিক’ বা ‘যথেষ্ট হয়েছে’।
এক প্রাচীন ঋষির মতে, নারীকে কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যাচ্ছিল না। এটা দাও, ওটা দাও; এ কর , ও কর, নারী কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। অসন্তুষ্ট নারী এক সময় তার মুখের কথাও বন্ধ করে দিল। তখন পুরুষ তাকে সুন্দর সজ্জাভূষিত হওয়ার জন্য নানা আকারের, প্রকারের গহনা দেয়া শুরু করল। আর গহনা পেয়েই নারী সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলে উঠল, ‘অলম’ যার বাংলা হলো, আর নয়, এই যথেষ্ঠ। এ অলম থেকে অলং অতঃপর হলো অলঙ্কার।
তবে গহনা বা অলঙ্কার সম্পর্কিত এ গল্প কতটুকু সঠিক বা বিশ্বাস্য তা বলা মুশকিল। গহনার প্রাচুর্য নারীর স্বকীয় চাহিদা থেকে এসেছে, না পুরুষ শাসিত সমাজে নারী পুরুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য অঙ্গে ধারণে বাধ্য হয়েছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। নারীবাদী লেখকদের মতে এগুলো হলো দাসত্বের প্রতীক। পুরুষরা ইতর প্রাণীকুলকে নিয়ন্ত্রণের আদলে নারীদের নিয়ন্ত্রণে সৌন্দর্য বর্ধনের ধুয়া তুলে নারীদের নাক-কান ছিদ্র করে এগুলো পরিয়েছে। জড়বস্তু জ্ঞানে পুরুষরা নারী দেহের উপর জড়োয়ার স্তূপ করেছে। আর অবলা নারী ইতর প্রাণীর মতো প্রতিবাদহীনভাবে এগুলো পরে আসছে যেন দাসীর দাসত্বই অলঙ্কার।
কিন্তু বিতর্কের ফলাফল যাই হোক, অঙ্গে অলঙ্কার ধারণে যে নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়, এটার সার্টিফিকেট দিতে নন্দনতত্ত্বের অধ্যাপক হওয়ার দরকার নেই।
রচনাসূত্র :
১. মাহমুদ শামসুল হক (২০০০),হাজার বছরের বাঙালি নারী, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ৬২/৬৫
২. রবীন্দ্রনাথ(), গল্পগুচ্ছ, বিচারক।https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/2238