স্বাধীন জাতির অগ্রযাত্রায় শিক্ষার গুরুত্ব
মানবজাতির আবহমান কালের অন্তর্জাত প্রবণতা যুদ্ধবিগ্রহ। অস্তিত্ব টিকে রাখার প্রারম্ভিক যূথবদ্ধ প্রতিবেশ মানব সমাজকে দেয় জীবিকার সন্ধান। তারপর প্রতিরক্ষার উদগ্র অভিলাষে বীরত্ব ও ক্ষমতা দেখানোর উন্মাদনায় সে হয়ে পড়ে বেসামাল। গবেষণার সুলুক অন্বেষণে প্রমাণিত হয় মানব ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তৈজসপত্রের বাইরে যুদ্ধ বিষয়ক উপাত্তই ঢের প্রাচীন। তথ্য সমীক্ষণ ও পরীক্ষণে এই অভিমত নৃতাত্ত্বিকবিদগণের। নৃতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড টেইলর বলেন- After the quest for food, men`s next great Need to defend himself. সঙ্গত কারণে তাই মানব সমাজের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যুদ্ধ প্রবণতা ও ক্ষমতা দেখানোর উল্লম্ফন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস শক্তি ও প্রভাব বিস্তার প্রতিযোগিতার ইতিহাস। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ন্যায় আজও পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের ক্ষমতাবলয় বিস্তৃত করতে বড্ড সক্রিয়। একটু চেতন মনে নিরিখ করলে তাই দেখা যায়, সামরিক জোট, অর্থনৈতিক চুক্তি এবং কূটনৈতিক সমঝোতা- সব কিছুই এক প্রকার বলয়ের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তির এই যুগে।
নিরেট সত্য হলো, এই খেলায় বৃহৎ শক্তিগুলোর আপন আপন স্বার্থের প্রসার ঘটলেও ছোটো রাষ্ট্রগুলোর ভাগ্যে অনিশ্চয়তার ছায়া ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে টিকে থাকতে হলে তাদের নেতৃত্বকে অতিশয় জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়ার বিকল্প নেই। ছোটো রাষ্ট্রের টিকে থাকার ভরসা কেবল তাদের শক্তির প্রদর্শন হতে পারে না । সুদূরপ্রসারী মেধা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখানোই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আজ আমরা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রীক প্রবণতা দেখতে পাই। তাই দেশগুলোর নেতাদের কণ্ঠে জনকল্যাণের ভাষণ থাকলেও বাস্তবে তারা নিমগ্ন থাকেন ধন-সম্পদ সঞ্চয় এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার কূট-কৌশলে। ফলে রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য, তথা সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নতির চিন্তাভাবনা পিছিয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। অনিবার্যভাবে তাই দৃশ্যমান হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগেরই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা অর্জনের মান খুব দ্রুত অবনতির পথে অপসৃয়মান।
বস্তুত কোনো দেশের শিক্ষা যখন অবনমিত হয়, তখন সমাজে দার্শন-মনস্ক আলোকিত নেতৃত্ব জন্ম নিতে পারে না। তাই তাদের ভাগ্য সমর্পিত হয় লোভ ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের হাতে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে সক্রেটিসের মাধ্যমে বলেছেন- “রাষ্ট্রের শান্তি ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠা হইবে কেবল তখনই, যখন শাসক দার্শনিক হবেন অথবা দার্শনিকগণ শাসক হবেন।” অর্থাৎ নেতৃত্ব মানেই কেবল ক্ষমতা নয় বরং প্রজ্ঞা, ন্যায় ও জ্ঞানের সমন্বয়। বিষয়টিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে পরিষ্কার করে আধুনিক চিন্তাবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল সতর্ক করে বলেন- ‘একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয় তাহার নাগরিকের গুণে। যে রাষ্ট্র সাময়িক স্বার্থকে স্থায়ী উন্নতির উপরে স্থান দেয়, তার পতন অবশ্যম্ভাবী।’ দার্শনিক মিলের এই উক্তির মধ্য দিয়ে এ কথা স্পষ্ট যে, জাতির উন্নতি নির্ভর করে নেতৃত্বের গুণগত মান, প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার উপর।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবতায় আমরা আজ উল্টো পথে চলার ছবি দেখতে পাই । একদিকে নাগরিকগণ নামমাত্র শিক্ষা গ্রহণ করে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে রাষ্ট্রনেতারাও ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়েই বিভোর। ফলে জ্ঞানশূন্য নেতৃত্ব রাষ্ট্রকে যেমন অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে, তেমনি ন্যায়, কল্যাণ ও শৃঙ্খলার অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠছে দুর্বিসহ; বিপদাপন্ন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস তার- ‘এ থিওরি অফ জাস্টিস’ গ্রন্থে বলেছেন- ‘সমাজের প্রধানতম গুণ হল ন্যায়।’ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে নেতৃত্বে ন্যায় ও প্রজ্ঞার অভাব দৃশ্যমান, সেখানে অনাচার ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনের পর দিন।
বিদ্বৎ সমাজ তাই উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে সর্বদা মনে করিয়ে দেয়, যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বে শৃঙ্খলা ও দূরদর্শিত না থাকে, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থায়ী না হয়ে রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হয়। বলতে দ্বিধা নেই, এই সতর্কবাণী আজ বহুলাংশে সত্য হয়ে উঠেছে পৃথিবীর ছোটো ছোটো দেশগুলোর ক্ষেত্রে। ফলে সাধারণ মানুষের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। পরাশক্তি রাষ্ট্রের বিবেচনাহীন নীতি ও অযাচিত হস্তক্ষেপ বিশ্বের অনেক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যস্ত করে তাদের আর্থনীতিক পরিবেশকে করছে সংকুচিত। একইসঙ্গে এই রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগের চলমান গতিকে স্থবির করে তাদের শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের পথ সুগম করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সৃষ্টি করেছে চরমতম বিপর্যয়। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো সম্প্রসারণের যে সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার আবহ দরকার, সে সুযোগ থাকছে তাদের নাগালের বাইরে। বাস্তবতা হল, বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সম্প্রসারণনীতির প্রবল চাপে এই রাষ্ট্রগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা শুধু বড়ো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না বরং রাষ্ট্রের ভেতর নানামুখী অপতৎপরতা মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় করছে বড়োই শঙ্কিত। ফলে এই অন্ধকারের মধ্যে ছোটো ছোটো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কগণ দেশের নাগরিককে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন অনবরত দেখালেও জ্ঞানহীন নেতৃত্ব সেই স্বপ্নকে ক্রমাগত বহুদূরে ঠেলে দিচ্ছে।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, যেখানে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, সেখানে উদয় হয়েছে আলোকিত নেতৃত্ব। রাষ্ট্রে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন-”শিক্ষা সেই শক্তিশালী অস্ত্র যাহা দ্বারা পৃথিবী পরিবর্তন করা যায়।” আর এই সত্য তৃতীয় বিশ্বের ছোটো ছোটো রাষ্ট্রগুলোর জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিজরেইলির সেই বিখ্যাত উক্তিটি-‘রাজনীতির মতো জুয়া পৃথিবীতে আর নাই।’ ফলে রাষ্ট্রের নাগরিক ও নেতৃত্বকে অবশ্যই যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কেননা শিক্ষা যেমন মানুষকে উদার করে, তেমনি করে একজন মানবিক মানব। করে অকৃত্রিম দেশপ্রেমে উজ্জীবীত। ফলে দেশের সকলের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া সহজ হয় সকলের জন্য। ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু বলেছিলেন- ‘আমি রাজনীতির যোগ্য নই, কেননা আমি প্রতিপক্ষের মৃত্যু কামনা করতে অক্ষম।’
এ কথার সত্যতা মিলে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জের কথায়। তিনি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ সম্পর্কে বলেন- ‘যার রক্তে রাজনীতি মিশে আছে তার কাছে এ জায়গাটি একজন মদ্যপায়ীর সরাইখানার মতো।’ সঙ্গত কারণেই আজকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য শিক্ষার মান উন্নয়ন ও আলোকিত নেতৃত্ব সৃষ্টি আশু প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র :
১. দ্য রিপাবলিক, প্লেটো, প্রবন্ধ হাসান আজিজুল হক
২. জা পল সার্ত্রে ও জন স্টুয়ার্ড মিলের প্রবন্ধ, বিজিত রায়, প্রতিভাস প্রকাশন, কলকাতা
৩. এবং মুশায়েরা, আলবেয়ার কামু, কলকাতা
৪. কবিতা সমগ্র, জীবনানন্দ দাশ, পুস্তক বিপণি, কলকাতা