‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেক নীড়ম্’ (বিশ্ব যেথায় এক নীড়ে পরিনত)। (পর্ব-১)
কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীর যাত্রার ইতিহাস।

বিশ্বে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা সবাই জানি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, দার্শনিক, অভিনেতা ইত্যাদিরূপে। আমার আজকের লেখায় আমি তুলে ধরব একজন ভিন্ন চিন্তার শিক্ষাবিদ আচার্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু-শিষ্যের সুগভীর সম্পর্ক গড়ার প্রকল্পের শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয় স্থাপনের ১৯০১ সাল থেকে ২০২১ সালের কেন্দ্রীয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার কথামালা। যে গুরুর মূলনীতি ছিল—
‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেক নীড়ম্’ (বিশ্ব যেথায় এক নীড়ে পরিণত)।
পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি করা আশ্রম শান্তিনিকেতনে তিনি স্থাপন করেছিলেন একটি স্কুল (১৯০১)। কবির এই সৃষ্টির সংকল্প ছিল—শান্তিনিকেতনে ভারতবর্ষের প্রাচীন কালের আশ্রমের শিক্ষা, তপোবনের আদর্শ এবং গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাঅর্জনের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। নিজ পুত্রসহ পাঁচজন ছাত্র নিয়ে যাত্রা করা এই বিদ্যালয়ের বর্ধিত রূপ হলো বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী (১৯২১)। যার প্রথম আচার্য ছিলেন কবিগুরু স্বয়ং এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন অত্র বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রবর্তিত শান্তিনিকেতনের এই শিক্ষাঙ্গন নানা কারণেই শিক্ষা-আগ্রহী ভাবুকদের কাছে স্বতন্ত্র এবং আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়েছে। বাঙালি ছাড়াও অবাঙালি ভারতীয় শিক্ষানুরাগী মানুষজন, পাশ্চাত্যের কতিপয় নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও গবেষক নানা সময়ে শান্তিনিকেতনে এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং কর্মকাণ্ডে কমবেশি অংশও নিয়েছেন। ফলে শান্তিনিকেতন শিক্ষায়তনের ছাত্র ও শিক্ষকমণ্ডলী আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেইসঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৩ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পাওয়া এই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার সঙ্গে প্রায়শই ভ্রমণে যেতেন। সেখানকার পরিবেশ তাকে বেশ আকৃষ্ট করত। যুবক বয়সে জমিদারির দায়িত্ব পালনকালে কবিগুরু তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সজাগ হন। নিজের শিশুকালের পাঠশালার তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং ব্রিটিশ বিরোধী ভিন্নধারা সীমিত ও সংস্কৃতি প্রসার ও প্রীতি লালনের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ (১৯০১) নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিক্ষালাভের প্রয়াসে তিনি তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদে শান্তিনিকেতনকেই বিদ্যালয় স্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলে মনে করেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে কবির মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ মানসিক বিকাশে সহায়তা করা। প্রচলিত অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পরিবর্তে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে মুক্ত পরিবেশে শিশুদের প্রকৃত প্রতিভা বিকাশে আগ্রহী করে তোলা। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতা হবে। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে (৭ পৌষ ১৩০৮ বঙ্গাব্দ) বোলপুরের নিকটস্থ শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ব্রহ্মচর্যাশ্রম" নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত বৃত্তিমুখী অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ মনোবিকাশের সুযোগ প্রদান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার পদ্ধতি হওয়া উচিত স্বাধীন এবং মুক্ত চিন্তার উপযোগী। তাঁর মতে, “শিক্ষা এমন হওয়া উচিত, যা ছাত্রদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং সৃজনশীল হতে উৎসাহিত করে।”তার বিদ্যালয়ে আবদ্ধ শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে অম্রকুঞ্জের খোলা জায়গায় মনোরম প্রকৃতির কাছাকাছি রেখে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদান করা হতো, যা পরবর্তীতে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিদ্যালয়ের শুরুটা ভারতের সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য করা হলেও পরবর্তীতে এটিকে বিশ্বজনীন সংস্কৃতি ধারণ ও চর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত করা হয়। তিনি তার দেশবাসীকে অন্ধদেশপ্রেম ও চেতনা থেকে মুক্ত করে বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে জাগ্রত করতে চাইতেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বিশ্বমানের তুলনায় এটি একেবারেই প্রাথমিক স্তরের। সেই বদ্ধ চিন্তা ও শিক্ষার অবগলা থেকে মুক্ত করতে সকল ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বিদ্যালয়ের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করেন এবং নাম পরিবর্তন করে ‘বিশ্বভারতী’ (২০২১) নামে যাত্রা শুরু করেন।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতা হবে। এর প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। পিতার আদর্শকে সমুন্নত রেখে, একই নীতিতে সহমত পোষণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করেছিলেন।