স্বাধীন জাতির অগ্রযাত্রায় শিক্ষার গুরুত্ব

Sep 12, 2025 - 12:06
Sep 12, 2025 - 11:07
 0  9
স্বাধীন জাতির অগ্রযাত্রায় শিক্ষার গুরুত্ব
ছবি এডিটঃ সম্পা রানী সরকার

মানবজাতির আবহমান কালের অন্তর্জাত প্রবণতা যুদ্ধবিগ্রহ। অস্তিত্ব টিকে রাখার প্রারাম্ভিক যূথবদ্ধ প্রতিবেশ মানব সমাজকে দেয় জীবিকার সন্ধান। তারপর প্রতিরক্ষার উদগ্র অভিলাষে  বীরত্ব ও ক্ষমতার দেখানোর উন্মাদনায় সে হয়ে পড়ে বেসামাল। গবেষণার সুলুক অন্বেষণে প্রমাণিত হয় মানব ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দেশনে তৈজসপত্রের বাইরে যুদ্ধ বিষয়ক উপাত্তই ঢের প্রাচীন। তথ্য সমীক্ষণ ও পরীক্ষণে এই অভিমত নৃতাত্ত্বিকবিদগণের। নৃতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড টেইলর বলেন- After the quest for food, men`s next great Need to defend himself. সঙ্গত কারণে তাই মানব সমাজের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যুদ্ধ প্রবণতা ও ক্ষমতা দেখানোর উল্ফন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস  শক্তি ও প্রভাব বিস্তার প্রতিযোগিতার ইতিহাস। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ন্যায় আজও পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের ক্ষমতা বলয় বিস্তৃত করতে বড্ড সক্রিয়। একটু চেতন মনে নিরিখ করলে তাই দেখা যায় সামরিক জোট, অর্থনৈতিক চুক্তি এবং কূটনৈতিক সমঝোতা সকল কিছুই এক প্রকার বলয়ের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তির এই যুগে।

 

নিরেট সত্য হলো এই খেলায় বৃহৎ শক্তিগুলো আপন আপন স্বার্থের প্রসার ঘটালেও ছোট রাষ্ট্রগুলোর ভাগ্যে অনিশ্চয়তার ছায়া ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে টিকিয়ে থাকতে হলে তাদের নেতৃত্ব  অতিশয় জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়ার বিকল্প নেই। কারণ ছোট রাষ্ট্রের টিকে থাকার ভরসা কেবল তাদের  শক্তির প্রদর্শন হতে পারেনা। বরং সুদূরপ্রসারী মেধা প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখানোই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আজ আমরা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা দেখতে পাই। এ কারণে এসব দেশের নেতাদের কণ্ঠে জনকল্যাণের ভাষণ থাকলেও বাস্তবে তারা নিমগ্ন থাকেন ধন-সম্পদ সঞ্চয় এবং ক্ষমতার ধরে রাখার কূট-কৌশলে। এর ফলে রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য তথা সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নতির চিন্তাভাবনা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। অনিবার্য ভাবে তাই দৃশ্যমান হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগেরই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা অর্জনের মান খুব দ্রুত গতিতে অবনতির পথে অপসৃয়মান হচ্ছে। 

 

বস্তুত কোন দেশের শিক্ষা যখন অবনমিত হয় তখন সমাজে দার্শনিক মনস্ক আলোকিত নেতৃত্ব জন্ম নিতে পারে না।  আর এ কারণে  তাদের ভাগ্য সমর্পিত হয় লোভ ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের হাতে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে সক্রেটিসের মুখ দিয়ে বলেছেন- ‘রাষ্ট্রের শান্তি ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠা হইবে কেবল তখনই যখন শাসক দার্শনিক হইবেন অথবা দার্শনিকগণ শাসক হইবেন।’ অর্থাৎ নেতৃত্ব মানেই কেবল ক্ষমতা নয় বরং প্রজ্ঞা, ন্যায় ও জ্ঞানের সমন্বয়। অন্যদিকে বিষয়টিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে পরিষ্কার করে আধুনিক চিন্তাবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল সতর্ক করে বলেন- ‘একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয় তাহার নাগরিকের গুণে, যে রাষ্ট্র সাময়িক স্বার্থকে স্থায়ী উন্নতির উপরে স্থান দেয় তাহার পতন অবসম্ভাবী।’ দার্শনিক মিলের এই উক্তির মধ্য দিয়ে এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, জাতির উন্নতি নির্ভর করে নেতৃত্বের বুদ্ধি ও বলিষ্ঠ গুণগত চরিত্রের উপর। 

 

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবতায় আমরা আজ উল্টো পথে চলার ছবি দেখতে পাই প্রতিনিয়ত। সেখানে একদিকে যেমন নাগরিকগণ নামমাত্র শিক্ষা গ্রহণ করে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে সে সকল দেশের রাষ্ট্রনেতারাও ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়েই অধিক মগ্নে বিভোর থাকছে। ফলে জ্ঞানশূন্য নেতৃত্ব রাষ্ট্রকে যেমন অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে, তেমনি ন্যায়, কল্যাণ ও শৃঙ্খলার অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠছে দুর্বিষহ ও বিপদাপন্ন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস তার- ‘এ থিওরি অফ জাস্টিস’ গ্রন্থে বলেছেন- ‘সমাজের প্রধানতম গুণ হইল ন্যায়।’ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে নেতৃত্বে ন্যায় ও প্রজ্ঞার অভাব দৃশ্যমান হচ্ছে সেখানেই অনাচার ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনের পর দিন। 

 

বিদ্বৎ সমাজ তাই উন্নয়নশীল দেশের মানুষকে সর্বদা মনে করিয়ে দেন যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বে শৃঙ্খলা ও দূরদর্শিত না থাকে, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থায়ী না হয়ে  রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলার দিকে ক্রমশ ধাবিত হয়। বলতে দ্বিধা নেই, এই সতর্কবাণী আজ বহুলাংশে  সত্য হয়ে ওঠেছে পৃথিবীর ছোট ছোট দেশগুলোর ক্ষেত্রে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। পরাশক্তি রাষ্ট্রের  বিবেচনাহীন নীতি ও অযাচিত হস্তক্ষেপ বিশ্বের অনেক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যস্ত করে তাদের আর্থনীতিক পরিবেশকে করছে সংকুচিত। একইসঙ্গে এই রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগের চলমান গতিকে স্থবির করে তাদের শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গের পথ সুগম করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সৃষ্টি করেছে চরমতম বিপর্যয়। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো সম্প্রসারণের যে সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার আবহ দরকার সে সুযোগ থাকছে তাদের নাগালের বাইরে। সত্যিকার বাস্তবতা হল বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সম্প্রসারণনীতির প্রবল চাপে এই রাষ্ট্রগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা শুধু বড় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না না বরং রাষ্ট্রের ভেতর নানামুখী অপতৎপরতা মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় করছে বড়ই শঙ্কিত।  ফলে এই অন্ধকারের মধ্যে ছোট ছোট রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কগণ দেশের নাগরিককে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন অনবরত দেখালেও জ্ঞানহীন নেতৃত্ব সেই স্বপ্নকে ক্রমাগত বহুদূরে ঠেলে দিচ্ছে। 

 

 

 

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় যেখানে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, সেখানে উদয় হয়েছে আলোকিত নেতৃত্ব। রাষ্ট্রে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেনসন ম্যান্ডেলা বলেছেন-‘শিক্ষা সেই শক্তিশালী অস্ত্র যাহা দ্বারা পৃথিবী পরিবর্তন করা যায়।’ আর এই সত্য তৃতীয় বিশ্বের ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।  এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিজরেইলির সেই বিখ্যাত উক্তিটি-‘রাজনীতির মত জুয়া পৃথিবীতে আর নাই।’ ফলে রাষ্ট্রের নাগরিক ও নেতৃত্বকে অবশ্যই যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কেননা শিক্ষা যেমন মানুষকে উদার করে, তেমনি করেে একজন মানবিক মানব। করে অকৃত্রিম দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। যার ফলে দেশের সকলের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া সহজ হয় সকলের জন্য। ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু বলেছিলেন- ‘আমি রাজনীতির যোগ্য নই, কেননা আমি প্রতিপক্ষের মৃত্যু কামনা  করতে অক্ষম।’

 

এ কথার সত্যতা মিলে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জের কথায় তিনি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন- ‘যার রক্তে রাজনীতি মিশে আছে তার কাছে এ জায়গাটি একজন মদ্যপায়ীর সরাইখানার মত।’ সঙ্গত কারণেই তাই আজকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য শিক্ষার মানউন্নয়ন ও আলোকিত নেতৃত্ব সৃষ্টি আশু প্রয়োজন। তা না হলে পরা শক্তির প্রতিযোগিতার ঘূর্ণিতে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে পারে খুব শীঘ্রই। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না পৃথিবীর শক্তিধর বলয়ের কূটকৌশলী খেলার মঞ্চে ছোট দেশগুলোকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই তাদের নেতৃত্ব জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দীপ্তিতে আলোকিত হতে হবে। আর এজন্য জনজীবনকে মুক্তি দিতে খুব দরকার বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী নেতা বা দার্শনিক মনন ও বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি যিনি বা যার দ্বারা সমগ্র জাতিকে পথ দেখবে সকল প্রতিকূল সময়ের বিপরীতে। তা না হলে কবি জীবনানন্দ দাশের সেই কথাটি চরম সত্য হয়ে আমাদের কাছে লালিত হবে-

‘সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী

মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে

উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার

বছরের বয়সী আমি।’   এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের উন্নয়নশীল ছোট ছোট রাষ্ট্রের জনগণকে সুশিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়ে অকৃত্রিম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। তা নাহলে অভিশাপের প্রবল বেগ সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের মানষের জীবনকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।