অলীক অঘটন

তখন দ্বিপ্রহর। গতরাত্রির প্রবল বারিবর্ষণের পর মধ্যগগনে প্রখর দিবাকরের রৌদ্রদাপট। পূর্বনিশির বর্ষণে পল্লীর পথেঘাটে সৃষ্ট অনতিবৃহৎ ও অনতিক্ষুদ্র গর্তে আশ্রয় লওয়া জল ইতোমদ্ধে প্রখর রৌদ্র দাপটে বাষ্পীভূত হওয়া আরম্ভ করিয়াছে। তদ্যপি মেদিনীপথের কিয়দাংশে পিচ্ছিল কর্দমার ছোপ দৃশ্যমান হইতেছে। গ্রামীণ পথের দুধারে বিস্তীর্ণ মাঠে সদ্য রোপিত শস্যের সলিল সমাধি ঘটিয়াছে।কোথাও কোথাও কিয়ৎ উঁচু বিটপের চূড়া সমাধি ভেদ করিয়া দিকে নত ভঙ্গিতে দৃষ্টিক্ষেপণ করিয়া দাঁড়াইয়া রইয়াছে। বৃক্ষরাজির কান্ড ও পত্রের সহিত বৃষ্টিজলের মিশ্রণে প্রকৃতিতে এক অনবদ্য মাদকতার উদ্রেগ ঘটিয়াছে।
গ্রামের কর্দমাক্ত মেদিনীপথে হাঁটিয়া যাইতেছিলেন তিন গাঁয়ের মোড়ল আসলাম গণি। প্রভাতে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক-কৃষাণিদের বিলাপ অনুষ্ঠানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপস্থিত থাকিতে হইয়াছিল। সেখান হইতেই দ্রুতপদে নিজ গৃহে ফিরিতেছিলেন। পরনে শুভ্র জোব্বা-পাজামা,পায়ে চর্মের জুতো। পাজামার আস্তিন কর্দমাখা হইবার শঙ্কায় উপরের দিকে গুটাইয়া লইয়াছেন। বগলের তলে কৃষ্ণ বর্ণের ছত্র। ছত্রের একাধিক ভিন্নরঙা তালি লোকের চক্ষুগোচর না হইবার নিমিত্তে তালি দেওয়া অংশটি বগলের আরো সন্নিকটে গুঁজাইয়া দিয়াছেন। মোড়লের বয়স পঞ্চাশোর্ধ, মস্তক কিয়ৎ কৃষ্ণ এবং কিয়ৎ অর্ধপক্ব কেশে পরিপূর্ণ। হাঁটিবার ভঙ্গি অদ্যাবধি যুবকদের ন্যায়।
দ্রুতপদে পথ দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে হঠাৎ তাহার দক্ষিণ পদের তলায় ভেজা পত্রের ন্যায় কি যেন ঠেকিল। অমনি অজ্ঞাত পত্রতলে থাকা পিচ্ছিল কর্দমায় পা পিছলিয়া সম্মুখে হুমড়ি খাইয়া পতিত হইলেন মোড়ল। আর নিস্তার কোথায়? সদ্য কাচা জোব্বার সহিত ঘটিল অর্ধশুষ্ক কাঁদার এক অবাঞ্চিত সংযোগ। দক্ষিণ পদস্থ চর্মের জুতা পা হইতে ছিটকিয়া কয়েক হস্ত দূরে গিয়া পতিত হইল, ক্ষীণ দূরত্বের নিমিত্তেই বোধহয় পথ পার্শ্বের পুষ্করিণীতে সলিল সমাধিস্থ হয়নাই।
অন্তহীন বিরক্তের সহিত মোড়ল পতিত অবস্থা হইতে অনেক কষ্টে নিজেকে পুনরুদ্ধার করিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইলেন। অদৃষ্ট যে, তাহার অস্থিমজ্জায় কোনো সংঘর্ষ ঘটেনাই। চারিপাণে দৃষ্টিপাত করিলেন, কেহ তাহাকে এমতাবস্থায় দেখিয়া ফেলিল কি না। তাহার কোনো প্রলক্ষণ কিংবা সম্ভাবনা না দেখিয়া কিঞ্চিত আস্বস্ত হইয়া নিজেকে সামলাইয়া লইয়া অলুক্ষণে পত্রের প্রতি অশ্রাব্য শব্দসমৃদ্ধ ভর্ৎসনা নিক্ষেপ করিলেন। এমন বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন তিনি অদ্যাবধি কভু হইয়াছেন বলিয়া তাহার স্মরণ হইল না। ছত্রটি তাহার সন্নিকটেই পতিত হইয়াছিল। এক হস্তে তাহা উঠাইয়া লইয়া অকর্মণ্য পত্রপাণে ক্ষুব্ধ ও বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টি নিপাতন করিলেন। কিঞ্চিত অবাকদৃষ্টিতে সেইপাণে কিয়ৎক্ষণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রহিলেন। অনুধাবণ করিলেন ইতি অবধি যাহাকে তরুপত্র ভাবিতেছিলেন তাহা আসলে একখানি মোটা অমসৃণ ভাঁজকৃত কাগজ। দেখিয়া বোধ হয় ইহার এই স্থানে আগমনকাল খুব অধিক নহে। কাগজখানি তুলিয়া লইয়া কিঞ্চিত কৌতূহলের সহিত ভাঁজ খুলিতেই মোড়লের চক্ষু চড়ক গাছে উঠিয়া গেল,সমগ্র দেহে ভীতির শিহরণ খেলিয়া গেল, ললাটে ঘর্মবিন্দু জমা হইতে লাগিল,দুশ্চিন্তার অপঘাতে কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় ঈষৎ উঁচুতে উঠিয়া গেল,নিজ হৃদপিন্ডের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি নিজ কর্ণগোচর হইতে লাগিল, দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হইতে আরম্ভ করিল। কাগজটিতে গোটা গোটা হরফে আরবিতে কি যেন লেখা। সর্বনাশ!
এই আরবি লেখা কাগজকেই তিনি কিয়ৎক্ষণ পূর্বে পদ দ্বারা পিষ্ট করিয়াছিলেন? তাহার দ্বারা এ কি মহাপাপ ঘটিয়া গেল?
এ পাপের দন্ড হইতে বাঁচিবার কি কোনরূপ উপায় বিদ্যমান রহিয়াছে?
অলীক পাপ হইতে কিঞ্চিত মুক্তি লাভের অভিপ্রায়ে কাগজখানি অধরের সম্মুখে ক্ষিপ্রবেগে তুলিয়া ধরিয়া চুম্বিতে লাগিলেন। কিন্ত ইহাতেও প্রায়শ্চিত্ত হইবে কিনা সেই সন্দেহ মোড়লের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে বারংবার আঘাত হানিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ একাগ্রচিত্তে চিন্তামগ্ন হইবার পর তিনি উপায় স্থির করিলেন। অতঃপর নিজেকে সামলাইয়া লইয়া দক্ষিণ পদের এক পাটি জুতো অকুস্থলে ফেলিয়াই ছত্রখানি কোনরূপে হস্তমধ্যে গুটাইয়া লইয়া তুরগবেগে ছুট দিলেন মক্তবপাণে।
মক্তবে অদ্য ছুটির দিন। নিকটস্থ মসজিদে যোহরের নামাজ পড়ানো শেষ করিয়া মক্তবের সদর কপাটের সম্মুখে পায়চারি করিতে করিতে একাগ্রচিত্তে জিকির করিতেছিলেন মক্তবের মোল্লা সাহেব। গত রাত্রের বৃষ্টিতে মক্তবের এক স্থলে চাল ফুটো হইয়া গিয়াছে, তাহা মেরামত করিবার উপায় মনে মনে স্থির করিতেছিলেন। প্রবীণ মোল্লা সাহেবের বয়স সত্তরের কম হইবেনা। এই ভরদুপুরে মোড়ল আসলামকে কর্দমাখা দেহে এমন উদভ্রান্তের মতো মক্তবপাণে ছুটিয়া আসিতে দেখিয়া মোল্লা সাহেব কিঞ্চিত অবাক এবং শঙ্কিত হইয়া পড়িলেন। তাহার কোনো বিস্মৃত কর্মে ক্ষিপ্ত হইয়া মোড়লের আগমন কিনা তাহা গম্ভীর চিত্তে সন্ধান করিতে করিতে মোড়ল তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। এতদূরত্বে এক দৌড়ে ছুটিয়া আসিবার নিমিত্তে তাহার যে প্রচুর শক্তি ব্যয় হইয়াছিল তা তাহার ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগের দরুণ বোধগম্য হইতেছিল। এই কারণবসত তাহার মুখ হইতে উদ্বেগের বাক্য নিঃসৃতে বেগ পাইতেছিল। ষাটোর্ধ্ব মোড়লের এমতাবস্থা পরিলোকন করিয়া তাহার দুই হস্ত করমর্দনের অভিপ্রায়ে মোড়লের দিকে আগাইয়া দিলেন। মোড়লের সেপাণে ভ্রূক্ষেপ না করিয়াই হা হুতাশ ভঙ্গিমায় কহিতে লাগিলেন,
মোল্লা সাহেব, 'পাপ হইয়াছে পাপ, বিরাট পাপ। ও আল্লাহ গো!'
মোড়লের এরূপ হাপিত্যেশ ও অসংলগ্ন কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গ অর্থ মোল্লা সাহেবের বোধগম্য হইল না। তিনি মোড়লকে মক্তবের অন্দরে প্রবেশ করিতে অনুরোধ জানাইলেন,কিন্তু মোড়ল তাহা কর্ণগোচর করিলেন না। ইতিমধ্যে তাহার সমস্ত বদন ঘর্মবিন্দু দ্বারা ভিজিয়া একাকার, তিনি অনতিবিলম্বে তাহার উত্তর হস্তের বিপরীত পৃষ্ঠ দ্বারা ঘর্ম মুছিয়া লইয়া কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ঘটিত ঘটনার আপাদমস্তক সমস্ত বর্ণনা করিলেন, কোনো অতি ক্ষুদ্র অনুঘটনও বাদ দিলেন। এরপর কাগজখানি মোল্লা সাহেবের পাণে উচিয়া ধরিয়া হাঁপাইতে লাগিলেন।
মোল্লা সাহেব এতক্ষণ মোড়লের বর্ণিত সমস্ত ঘটনাবলি মনযোগ দিয়া শুনিতেছিলেন, এতক্ষণে তাহার ঘোর কাটিল। তিনি অবিলম্বে মোড়লের হস্ত হইতে কাগজখানি নিজ হস্তে লইয়া কাগজের আরবি লেখনি কর্ণগোচর হয়না এমন ধীর আওয়াজে পড়িলেন। পড়া শেষ হইতেই তাহার মুখের ভাব বদলাইয়া গেল। ললাটের চিন্তার রেখার পরিবর্তে কৌতুকের রেখা প্রকাশ পাইলো। তিনি ক্ষীণ তম্বুলারক্ত দু সারি দ্বন্ত বাহির করিয়া একরাশ হাসিয়া কাগজ পুনরায় মোড়লের পাণে আগাইয়া দিয়া কৌতুকের স্বরে কহিলেন,
মোড়ল সাহেব, 'আপনি এই কারণে এত শঙ্কিত হইয়াছেন?আপনি পারেনও বটে।'
এই বলিয়া পুনরায় উচ্চস্বরে হাসিতে লাগিলেন।
মোড়ল আসলাম এইবার কিঞ্চিত বিরক্ত হইলেন।
মোড়ল কহিলেন, 'আরে! আপনি এমন করিয়া হাসিতেছেন কেন? আমার শঙ্কার নিমিত্ত কি আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না?'
অট্টহাস্যের ভঙ্গিতে মোল্লা সাহেব কহিলেন, 'শঙ্কা? কিসের শঙ্কা? আমি তো কোনোরূপ শঙ্কা দেখিতেছিনা?'
‘ইহার মানে কি?’
নিজের হাস্যভঙ্গিমাকে সংযত করিয়া নিজেই মোড়লকে কাগজ খুলিয়া দেখাইলেন,
'এইতো নিজ চক্ষেই দেখিয়া লওন। এইখানে আরবিতে লেখা রইয়াছে 'ইবলিশ'।'
এইবার মোড়ল রাগে ফাটিয়া পড়িলেন। কণ্ঠস্বর কর্কশ করিয়া কহিলেন,
'ইবলিশ মানে? ইবলিশ কহিলেন কাহাকে? আপনার হিম্মৎ তো কম নহে।'
মোল্লা সাহেব এইবার নিজেকে সামলাইয়া লইয়া ব্যতিব্যাস্ত হইয়া কহিলেন,
‘আরে! আপনাকে ইবলিশ কহিব কোন দুঃখে? এইতো এইখানে দেখুন, লেখা রহিয়াছে, আলিফ বা হামজা যের ‘ঈব’, লাম যের আইন সীন ‘লীস’, দুইয়ে মিলিয়া ‘ইবলিশ’। আপনি এই ইবলিশকে চুম্বন করিতেছিলেন?’, এই বলিয়া পুনরায় অসমান দ্বন্ত সারিদ্বয় বাহির করিয়া চাপা স্বরে হাসিতে লাগিলেন।
এইরূপ দেখিয়া ও শুনিয়া মোড়লের ধৈর্যের বাঁধ সম্পূর্ণ ভাঙ্গিয়া গেল। তাহার মস্তকে বহ্নি জ্বালিয়া উঠিল। গ্রীবার স্বরকে সর্বোচ্চ উঁচুতে তুলিয়া মোল্লা সাহেবকে এক বিকট ধমক দিলেন,
'চুপ রহ বেয়াদপ! তোমার হিম্মৎ দিন দিন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইতেছে। তুমি আমাকে উপহাস করিতেছ? আমাকে জ্ঞান প্রদান করিতেছ? তুমি ইহা জানো যে আমি কে? মনে করিয়াছ যে আমি ধর্মের কিছু বুঝিনা হে? আরবি লেখা তো আরবি লেখাই, তাহা 'আল্লাহ'হউক আর 'ইবলিশ' হউক? তাহাতে কি যায় আসে? তোমাদের মোল্লাদের জোচ্চুরি আমি কিছু বুঝিনা ভাবিয়াছ? ব্যাটা বে-ইমান, ধর্মদ্রোহী? দাঁড়াও তোমার মোল্লাগিরি আমি ঘোঁচাইতেছি? এক্ষুনি উপর তলায় নালিশ করিয়া তোমার বদলি করিবার ব্যবস্থা করাইতেছি। ব্যাটা বদমায়েশ কাঁহাকা।'
মোল্লা সাহেব এতক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া প্রস্তরের ন্যায় দাঁড়াইয়া মোড়লের ভর্তসনা শুনিতেছিলেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নাই। মোড়ল তাহার হস্ত হইতে কাগজখানি ছিনিয়া লইয়া,আরও কতকবার তাহাতে চুম্বন করিয়া,মোল্লা সাহেবের পাণে আরও কতক কটুবাক্য নিক্ষেপ করিয়া, বদলি করাইবার হুমকি পুনরুল্লেখ দ্রুতপদে গৃহ অভিমুখে রওনা হইলেন। মোল্লা সাহেব তাহার পাণে চাতক বিহগের ন্যায় একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।
আকাশের সূর্য মধ্যগগন হইতে পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িতেছে।উত্তর গগনে মেঘমালা পুঞ্জীভূত হইয়া মধ্যগগনের দিকে ধাবিত হইতেছে। তাহার সহিত দক্ষিণ গগন হইতে মৃদু পবন এপাণে বহিয়া আসিতেছে। অদ্য নিশিতেও বৃষ্টি হইবে।