একাত্তরের তেলিয়া পাড়া সম্মেলন: ওসমানীর পিস্তল ফায়ারে স্বাধনিতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক যাত্রা

আমারদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। এ দিবসের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর সর্ব শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এক দিকে সমঝোতার কথা বলে আলোচনা, অন্যদিকে অতি গোপন পাকিস্তান থেকে বিমানে করে বাংলাদেশে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করন-- এ দুইয়ে মিলে আমাদের জাতীয় নেতাদের সাথে প্রতারণার নাটক মঞ্চস্থ করেছিল ইহাহিয়া খানের সামরিক সরকার। শেষ পর্যন্ত বাংলার মানুষকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত রেখেই তারা পরিপূর্ণ সামরিক অভিযান শুরু করেছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্সলাইট’।
ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে, বিশেষ করে ক্যান্টমেন্ট সংলগ্ন শহরগুলোতে তারা নিরীহ মানুষের উপর হত্যা যজ্ঞ শুরু করে। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেই ( সেই সময় ইকবাল হল) তারা হত্যা করেছিল প্রায় দুইশত ঘুমন্ত ছাত্রকে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আটটি সেনা ব্যাটালিয়ন ছিল যাদের তিনটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ও পাঁচটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে। এই পাঁচটির মধ্যে দুইটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি অফিসার।
কৌশল হিসেবে পাকিস্তানি জান্তারা বাঙালি ব্যাটালিয়নগুলোকে বিভক্ত করে একেকটি কোম্পানিকে এক এক স্থানে পাঠিয়ে যাতে তারা একত্রিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার বাঙালি অফিসার ও ফার্সকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে তাদের নিরস্ত্র করান চেষ্টা করে।
কিন্তু পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের কথা আঁচ করতে পেরে বাঙালি সেনা ব্যাটালিয়ন ও অফিসার ফোর্সগণ তাদের মতো করে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
যশোর সেনাবিসাসে অবস্থিত প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সদস্যরা ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে এসে পড়ে। কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ইপিআর এর মেজর আবু ওসমান, চট্টগ্রামের প্রতিরোধ গড়ে তোলেন অষ্টম বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান এবং ইপিআর এর ক্যাপ্টেন রাফিক ।
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সহ অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর সাফায়েত জামিল কুমিল্লা অঞ্চলে এবং দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এ কে এম শফিউল্লাহ প্রায় পুরো ব্যাটালিয়নকে নিয়ে গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের দিকে চলে যান। এখানে তার সাথে যোগদেন অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান।
রংপুরে অবস্থিত তৃতিীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এর অফিসারগণও ব্চিছন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অনেক সেনা কর্মকর্তা ছুটিতে থাকা অব্সথায় কোন কোন ব্যাটালিয়নের সাথে যুক্ত হয়।
কিন্তু ২৫ মার্চের পর প্রায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এসব সেনা সদস্যরা অনেকটাই বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের রক্ষা ও পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। সঙ্গত কারণেই তারা তখন পর্যন্ত একে অপরের সাথে কার্যকর কোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেননি।
এর মাঝে অবসরপ্রাপ্ত অনেক সেনা অফিসার কোন রকমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছান। এদের অন্যতম ছিলেন কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর রাজনীতিতে যোগ দেন এবং আওয়ামী লীগের ব্যানারে জাতীয় পরিষদের সদস্য(এমএনএ) সদস্য নির্বাচিত হন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধরত বাঙালি সেনা কমান্ডারগণ সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যুদ্ধকৌশল গ্রহণের জন্য একত্রিত হওয়ার চিন্তা করে। সেনা অফিসারদের মধ্যে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন মেজর খালেদ মোশারফ ( পরে মেজর জেনারেল ও সেনা অভ্যূত্থানে নিহত)। তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধাী আগরতলা সীমান্তের কাছাকাছি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জসহ আশে পাশের এলাকায় যুদ্ধরত থাকায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কর্নেল (অব) আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে আগর তলা সীমান্তে সকল সেনা কমান্ডারদের একত্র করে একটি বৈঠকের চেষ্টা করেন।
এসময় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন জেনারেল ওসমানী। তিনি ভারতের বিএসএফের পূর্বাঞ্চলেরকমান্ডার বিগ্রেডিয়ার ভি সি পান্ডে, ভরতীয় সেনাবাহিনীর বিগ্রেডেয়ার শুভ্রনিয়াম ও আগর তলার জেলা মেজিস্ট্রেট ওমেস সায়গলকে প্রস্তাবিত বৈঠকে উপস্থিত থাকার আহব্বান জানান। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সুবিধার জন্য মেজর খালেদ মোশারফের নির্দেশনায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষের সহায়তা চা বাগানের গাছ কেটে কেটে আগরতলা সীমান্ত পর্যন্ত একটি কাঁচা রাস্তাও তৈরি করান।
অবশেষে আগর তলা সীমান্তের খুব কাছে বাংলাদেশের বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাস ভবনে ১৯৭১ সারের ৪ এপ্রিল কাঙ্খিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ভারতের কর্মকর্তারা ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনা কারী প্রায় ২৭ জন বিভিন্ন পদবীর সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের ধ্যে মেজর খালেদ মোশারফ ছাড়াও, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সিআর দত্ত, মেজর এ কেএম শফিউল্লাহ, মেজর সাফায়ত জামিল, কর্নেল (অব) লে. কর্নেল (অব) কাজী নুরুজ্জামান, মেজর(অব) সিআর দত্ত প্রমূখ। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও জাতীয় পরিষদের সদস্য আশ্রাফ আলী, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, মাওলানা আসাদ আলী ও মোস্তফা আলীও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সিদন্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও বহির্বিশ্বের সমর্থন ও সহযোগীতা আদায়ের জন্য একটি বেসামরিক সরকার গঠন করতে হবে। এ জন্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করা রাজনীতিবিদ ও নেতাদের খুঁ জে বের করে একত্র করতে হবে। একাজের জন্য ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ভারত সরকারের সর্বাত্মক সাহায্য ও সহিযোগিতার জন্য উপস্থিত ভারতীয় সেনা অফিসার ও আগরতলার জেলা মেজিস্ট্রেকে অনুরোধ করা হয়। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
বৈঠকে বাংলাদেশকে আপাতত চারটি সেকটরে ভাগ করে প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য একজন করে কমান্ডাররে নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওারও সিদ্ধান্ত হয়। সেক্টরগুলোর মেধ্য চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম, ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে, নোয়াখালী ও কুমিল্লার আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ফরিদপুর ও ঢাকার অংশ বিশেষের জন্য দায়ত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশারফকে, বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিং জেলার পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহকে এবং সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর, ফরিদপুর জেলা এবং দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাশে যুদ্ধ পরিচালনার দাযিত্ব দেয়া হয় মেজর আবু ওসমানকে। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে আগমী ১০ এপ্রিল আরও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সর্বসম্মতভাবে সমগ্র মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। কর্নেল ওসমানী দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক পিস্তলে গুলি ফায়ার করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।
তেলিয়া পাড়ার বৈঠকটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নানা দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে সময় দেশের রাজনীতিবিদগণ দিকভ্রান্ত, জাতীয় নেতাদের কে কোথায় আছে একে অপরজন জানে না এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তান কারাগারে ঠিক এসময় দেশের রাজনীতিবিদদের অনুপস্থিতেই সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী সেনানায়কগণ মুক্তিযুদ্ধকে সংঘটিত রূপ দেয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। একই সাথে এটাও সঠিক যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া যে কোন যুদ্ধই সফল হতে পারে না, সেনা কর্মকর্তাগণ তাও উপলব্ধি করেছিলেন।
যাহোক, তেলিয়াপাড়ায় নির্ধারিত দ্বিতীয় মিটিং অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই ১০ এপ্রিল কোলকাতায় তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয় যারা ১৭ এপ্রিল দেশের পশ্চিমাঞ্চলের মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে। এগিয়ে চলে আমাদের সশস্ত্র প্রতেরোধ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সরকার পরিচালনা ও সেনা নায়কদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিডসেম্বর অ র্জিত হয় নামাদের কাঙ্খিত বিজয়। বিশ্বের বুকে স্থান করে নেয় আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।