‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেক নীড়ম্’ (বিশ্ব যেথায় এক নীড়ে পরিণত) (২য় অংশ)

May 22, 2025 - 17:40
May 22, 2025 - 18:57
 0  11
‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেক নীড়ম্’ (বিশ্ব যেথায় এক নীড়ে পরিণত) (২য় অংশ)

রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়ার্ধ জীবনের অধিকাংশ কেটেছে পিতার করে যাওয়া শান্তিনিকেতনকে ঘিরে—তার তৈরি ভিন্নধর্মী পাঠশালা ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও তার বিস্তারের সংকল্পে। সাহিত্য ও শিল্পকর্মের এই আশ্রমের চত্বর ঘিরে বসবাসের জন্য স্থাপত্য অনিন্দ্য একটি ভবন নির্মাণ করেন। রবীন্দ্রনাথ আশ্রমে থাকলেই নিয়ম করে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন, খাতা সংশোধন করতেন। কেবল পাঠদানই নয়, ছাত্রদের জন্য নতুন নতুন ক্রীড়াকৌশল উদ্ভাবন করতেন। ১৯০১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির পরিসর বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। শুরুতে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে কোনো ডিগ্রি দেওয়া হতো না, কিন্তু এখন বিশ্বভারতী ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিটি পর্যায়েই সমমানের ডিগ্রি প্রদান করে।

 

ব্রহ্মচার্য বিদ্যালয়ের প্রাথমিক খরচ আসত এই আশ্রম থেকে। মাসিক মাত্র ১৮০০ টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যালয় পরিচালনা করা হত।এছাড়া আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে যে অর্থাভাব ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ মিটিয়েছেন সানন্দে নিজস্ব সঞ্চয় থেকে, স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর অলংকার বিক্রয়ের মাধ্যমে। তিনি রবীন্দ্র পুরীতে অবস্থিত নিজের বাংলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের বিস্তার ও প্রবৃদ্ধির কাজে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার থেকে পাওয়া অর্থও এই কাজে ব্যয় করেন। নোবেল পুরস্কার বাবদ তিনি ৮,০০০ পাউন্ড পেয়েছিলেন, যা সে সময় ভারতীয় মূল্যে ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেন বিশ্বভারতী (১৯১৯) এবং নিজেই এর স্লোগান রচনা করেন—“যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম”, অর্থাৎ বিশ্ব যেখানে এক নীড়ে পরিণত হয়। কবির লক্ষ্য ছিল বিশ্বভারতীকে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করা। কবির এই অভিলাষ পূরণে ১৯২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হয় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে আমৃত্যু এর চ্যান্সেলরের (আচার্য) দায়িত্বে ছিলেন।

১৯২২ সালে তিনি তাঁর সকল বাংলা গ্রন্থাবলির গ্রন্থস্বত্ব বিশ্বভারতীকে দান করেন। প্রাথমিক অবস্থায় শিক্ষকদের কাছ থেকেও সহায়তা এসেছিল। ইংল্যান্ডের ডব্লিউ. ডব্লিউ পিয়ার্সন এবং সি.এফ. এন্ড্রুজ তাঁদের সর্বস্ব বিদ্যালয়ে দান করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডরোথি এমহার্স্ট স্ট্রেইট এবং ইংল্যান্ডের লিওনার্ড এমহার্স্ট শান্তিনিকেতনের উন্নয়নের জন্য ডার্টিংটন হল ট্রাস্ট থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দান করেছিলেন। ত্রিপুরা, বরোদা, জয়পুরসহ বিভিন্ন রাজপরিবার এবং স্যার রতন টাটাও শান্তিনিকেতনে প্রচুর দান করেছিলেন।

বিশ্বভারতীর বিভিন্ন বিভাগগুলি হল—পাঠ্যভবন, উত্তরশিক্ষা সদন, মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা, শিক্ষাসত্র, সন্তোষ পাঠশালা, পদ্ম ভবন, ভাষা ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যা ভবন, রবীন্দ্র ভবন, চিনা ভবন, নিপ্পন ভবন, কলা ভবন, সংগীত ভবন, শিল্প সদন, হিন্দি ভবন, বিনয় ভবন, শিক্ষা চর্চা, পল্লী সংঘটন বিভাগ, পল্লী শিক্ষা ভবন, রথীন্দ্র কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, বাংলাদেশ ভবন, ইন্দো-তিব্বত ভবন।বিশ্বভারতীর কিছু স্বনামধন্য প্রাক্তনীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, এবং জয়পুরের রানী গায়েত্রী দেবী।

শান্তিনিকেতনে সারা বছরই বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে সমুজ্জ্বল রাখা হয়। এর মধ্যে রবীন্দ্রজয়ন্তী, বসন্ত উৎসব, বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব, নন্দনমেলা, পৌষমেলা ও মাঘমেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।বিশ্বভারতী একটি ছোট্ট বিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পথে বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সংকট ও সমাধান এসেছে। তবে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাশক্তি, প্রিয়জনের আন্তরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আজও শান্তিনিকেতনের নন্দিত ক্যানভাস গবেষক, পর্যটক ও পণ্ডিতদের আকর্ষণ করে, বিশ্ব কবির স্মৃতির স্পর্শে সবাই এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ করেন।


Farhana Parvin Farhana Parvin is a Teacher of APBN Public School & College, Bogura. (ICT), Master Trainer of Digital Technology. Belong Science background, Also trained as a Graphics Designer as well.