যুগান্তরের মশাল

Mar 13, 2025 - 18:30
Mar 13, 2025 - 17:41
 1  16

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখে লুনার গত দীপাবলির রাতে দেওয়া শিশির মাখা কলাগাছের ট্রে ভেঙে পড়ে আছে। জোয়ান মোরগটিও ডাকেনি । পিছনে দুয়ার খুলে কলপাড়ের পাশে উর্ধ্বমুখী মেহেদী গাছটিও বলাৎকারের পর ক্ষতবিক্ষত নারীর মৃতদেহের মতো পড়ে আছে । চোখ ভিজে জল আসে । দূর বিল থেকে সহপাঠীদের সাথে একধরনের জলজ আগাছা তুলে এনে তার ভিতর থেকে স্পন্স বের করে রোদে শুকিয়ে এইদিনের অপেক্ষায় থেকেছে । সর্ষের তেলে ভেজা টুপটুপে স্পন্সগুলো আগুন জ্বালিয়ে অমাবস্যার শিশির ছুঁয়ে মুখে লাগিয়ে চির সুন্দরী হবে। সৌন্দর্য যদিও ভিতরের জিনিস,মনের,তবু প্রসাধনীর দোকানগুলো মিছে গরম করে বুদ্ধিহীন নারীরা । লুনাও এই দলে । এইতো সন্ধ্যায় কিছু স্পন্স কেরোসিনে ডুবিয়ে ছেলেমেয়ের দলে এক হয়ে সারা মাঠে যুগান্তরের মশাল জ্বালায় লুনা, দলবদ্ধ শ্লোগানে কেঁপে তোলে মাঠ,পাড়া, গ্রাম,দিগন্ত । 'সরষা গেল,মশা এল,ওলো বাতি হো হো ।' যে অমাবস্যাতে যুগ বদলের মন্ত্রনা, যুগের গতি থামিয়ে তাতেই চোরের সিদ্ধির সাধনা । এই রাতে চুরিতে ধরা না পড়লে সাধনা পূর্ণ হবে,আর কোনদিন ধরা পড়বে না । তাই সে বৃহৎ কর্মে সিদ্ধি লাভে প্রত্যেক বাড়িতে কিছু না কিছু চুরি হয়। স্যান্ডেল, লুঙ্গি, মুরগি, হাঁস, ফুলের গাছ কোনটা বাদ যায় না। পাড়ায় পাড়ায় চলে পাহাড়া। কবরস্থানে চলে কড়া নজরদারি । লাশ চুরির ভয়। যাদু টোনায় অমর হতে হলে এই সময়ে সদ্য মৃতের মাথা কাটতে আসে অনেক যাদুকর।বিবস্ত্র অবস্থায় কিছু সূরা উল্টো করে পাঠ করলে নাকি চরচর করে লাশ উপরে উঠে আসে। লাশের কান্না আর অনুনয় উপেক্ষা করে এক কোপে মাথা কেটে নিয়ে যায় এই পাষণ্ডের দল। কী সাংঘাতিক স্পর্ধা ! পাড়ায় একবার এক জাদুকরের ঝুলিতে কাটা মাথা দেখেছে লুনা । যাদু খেলায় সাথে থাকা এক বালককে জবাই করে আবার জীবিত দেখাতে চাইলে লুনা ও তার সমবয়সীরা চিৎকার করে কাঁদে। শেষে খেলা বন্ধ হয়েছে । সেদিন প্রতারকের প্রবঞ্চনা বোঝার বয়স হয়নি লুনার । এই রাতে নাকি খোকসা গাছে ফুল ফোটে , বিষাক্ত সাপ পাহাড়ায় থাকে। বুকে সাহস নিয়ে ফুল সংগ্রহ করতে পারলে অঢেল সম্পদ লাভ হয়। কতজনই নাকি লোভে পড়ে যায় , কিন্তু ভয় পেয়ে সাপের ছোবলে মারাও যায়। বাড়ির আশেপাশে অনেক খোকসা গাছ । দিনে কতবার পাতা ছিঁড়েছে । ভয় পায়নি। কখনো সে খোকসার ফুল দেখেনি। রাতে যাবার সাহস নেই । জিন সাপের রূপ ধরে বসে থাকে।সে অপূর্ণতা রয়ে গেছে।দাদা বলেছেন , চুরি মহাপাপ। তবে কেন সে পাপপথে এত ভিড় । দেশ কী চোরের আধিপত্যে ? যুগান্তরের মিছিলে যারা ছিল তারাও..কী..?

তবে প্রত্যেক জমিতে যে প্রজ্জলিত মশাল, যুগের আগুন,তা মিথ্যে? ভাবতে পারে না।আদিবাসী ছেলেমেয়ের দল এসে সে পাপপথে এত ভিড় । দেশ কী চোরের আধিপত্যে ? যুগান্তরের মিছিলে যারা ছিল তারাও..কী..? তবে প্রত্যেক জমিতে যে প্রজ্জলিত মশাল, যুগের আগুন,তা মিথ্যে? ভাবতে পারে না।আদিবাসী ছেলেমেয়ের দল এসে মিশে এ দলে।যে আঁধারকে তাড়াতে অগ্নি মশাল, সে আঁধার ফুঁড়ে দাঁড়ায় অসংখ্য শক্তিধর ,আঁধার মানব অনড় প্রাচীরের মত । কে ভাঙবে?কারা রুখবে? অজানা।

সারা রাত ধরে চলে শক্তির আরাধ্য। পথের পাশে খোলা মন্ডপে চলে দেবী কালীর তুষ্টিতে বলিদান। আদিবাসী, হিন্দু,মোসলমান ছেলেমেয়ের ভিড়। কাদের উৎসব, কাদের আনন্দ বোঝা কঠিন। বারান্দার বাঁশের খুঁটি কেটে টাকা জমিয়েছে লুনার ছোট চাচা।গুনে গুনে একুশ টাকা। লুনার বায়না কাঠের পুঁথির মালা কিনে দিতে হবে । চাচার সাথে সেও মেলায় যায় । কান মুচড়ি, ছাঁচে গড়া হাতি,মাছ,ঘোড়া, প্রভৃতি আকৃতির মিষ্টি, বুন্দিয়া এবং সখের পুঁথির মালা কিনে বাড়ি ফেরে.. পায়ে হেঁটে.. কিন্তু মনের মধ্যে থেকে যায় মোরগ বন্ধু আর বাল্যসখী মেহেদী গাছটি। ভুলতে পারে না..