আঁধারের আলেয়া
আলেয়া যদিও আলো নয়,প্রহেলিকা--তবু আলোভোরে শিশির আর শৈত্য মাড়িয়ে ছুটে যায় দিগন্তে। রোদ্দুর গায়ে মেখে খালিপায়ে, খোলাচুলে বকুল-নেশায় ছোটে অগন্তব্যে। খোঁজে বুনো ফুল, বুনো গন্ধ।যে গন্ধ তার বুকেও।হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় চাঁদনী স্নাত বিরাট আকাশের বিস্ময়। দুরন্ত ছেলে সহপাঠীর সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুতগামী মাছের মত সাঁতার কাটে উদোম বিলে।শীর্ণ গাছে তরতরিয়ে শীর্ষে উঠে বুড়ো সুপুরি পেড়ে মাকে অবাক করে। সবই তার সহজাত স্বভাব। তবু নীরব দুঃখবোধ!যদি সে ছেলে জন্ম পেত! সন্ধ্যার উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে ছিঁড়ে এনে আঁধারপ্রদীপ বানাতো অথবা মুঠোবন্দী জোনাকি ছড়িয়ে দিত ঘর ভরে।আলোয় আলোময়। এত আলো ভালোবেসেও সে আজ ঘরবন্দি।
এখন বড় অসময়।শেখ সাহেবের কথা শুনে সব মানুষ দেশ বাঁচাতে পথে নামে আর পাকিস্তানিরাও রক্তের হুলিখেলায় মত্ত। 'মা বলে,ঘর থেকে বের হবি না,সবার চোখে লাগবে'।কিশোরীর তাচ্ছিল্যভরা উত্তর-- 'আমি কি টর্চলাইটের আলো যে চোখে লাগবে'?প্রায় সময় বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে। উঠোনের অথর্ব আমগাছের অসহায়ত্ব নিয়ে আলেয়া তাকিয়ে থাকে ক্ষীণ আলোপথে। কখনও শোরগোল পেলে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয় মা।
একদিন দুজন মানুষকে ধরে আনে পাকিস্তানি আর্মি। তথ্য দিয়ে পাশে থাকে পাড়ার মাঝবয়সী চাচা এবং গ্রামের মাতব্বর গোছের আরো একজন।আলেয়াদের পাড়ার প্রশস্ত মাঠে বড়গাছে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়।অপরাধ যুদ্ধে যাওয়া।বেয়োনেটে ফুটো করে পেট,শরীরের বিভিন্ন অংশ।আর্তনাদ আর আতঙ্কে, প্রকম্পিত চারপাশ!কাটা অংশ থেকে ক্রমশ রক্তনদী বাংলার মাটি ভিজে বৃহত্তর রক্তসাগরে মিশে। ফুলে-ফেঁপে উঠা পঁচা মা়ংসের গন্ধে জড়ো হয় শেয়াল-কুকুর। নির্মম নগ্নতায় আড়ষ্ট চাঁদটিও মুখ লুকায় আর কপাটবন্ধ ঘরে কাটা মুরগীর মত ছটফটায় পাড়াসুদ্ধ মানুষ।একদিন-দুদিন-তিনদিন.. তারপর ঝুলন্ত প্রাণ বৃন্তচ্যূত পাপড়ির মতো নিঃশব্দে চলে যায় অনন্তলোকে।জাতভাইয়ের রক্তমদ আর হৃষ্ট ছাগল রানে দাঁত বসিয়ে রুচির বিকারে মাতে দুজন ঘৃণ্য স্বজাতি! তাদের দিবাস্বপ্ন ঘিরে আধিপত্যের দখলী সুখ।
জৈবিক চাহিদা মানুষের প্রাগৈতিহাসিক।নারীসঙ্গ বিবর্জিত পাকিস্তানি আর্মি শরীরের জমানো ক্ষুধায় আদিম উন্মাদনায় মেতে উঠে। একদিকে অস্তিত্ব সঙ্কটে টর্চার সেলে চাবুক,বেয়োনেট,লাঠি,রড, বন্দুকের আঘাতে পুরুষরক্তে অমরত্বের অনুসন্ধান;অন্যপাশে আয়েশি বিছানায় বাড়ে গণভোগী কিশোরী-যুবতীর মৃত শরীর !
গ্রামে মিলিটারি গাড়ি থামে। কান্না আর হাহাকার।আলেয়া নিষিদ্ধ সীমা ডিঙিয়ে পা রাখে উঠোন, চৌকাঠ, বাহির।বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে নিয়ে যায় স্বজন, প্রতিবেশী অনেককে। আর্মিদের সাথে পাড়ার চাচা!আলেয়াকে দেখে আর্মিকে ইশারা করতেই দৃষ্টি ঘুরায়।চকচকে শিকারী চোখ!কিছু ঘটার আগেই এক দলা থুতু ছিটিয়ে আলেয়া দৌড় দেয়। আম-কাঁঠালের বাগান ঘেরা নিচু প্রাচীর টপকাতে পারলেও পা ছোঁয়া দীঘল ঘনচুল ধরে ফেলে কামুক হাত।কৌশলী ঝটকায় আলগা হয় রেশম কোমল কেশাগ্র।আলেয়া দৌড়ায়।মরণদৌড়! ঘর ছেড়ে, বাগান ছেড়ে,পাড়া ছেড়ে..সাথে মেঘসম ছড়ানো চুলের রহস্যরাশি!যেমন ,'বিদিশার রহস্যঢাকা বনলতা' জীবনানন্দ মনে ! স্তব্ধ ঘোরে পেছনে দৌড়ায় আর্মি, দৌড়ায় চাচা।আলেয়া ছোটে এক পিঠ ধাঁধা ছড়িয়ে শকুন দৃষ্টির আড়ালে ..
গাঢ় আঁধারে ঢাকা পড়ে গ্রাম।বড়গাছের নিচে আবার ও জটলা বাঁধে ক্ষুধার্ত শেয়াল-কুকুর।
তখনও নির্দোষ কিশোরের নিখোঁজ শূন্যতায় প্রলাপ করে মা…