গের্টি তেরেসা কোরি: চিকিৎসা বিদ্যায় নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী

Dec 20, 2024 - 02:05
Dec 20, 2024 - 02:04
 2  54
গের্টি তেরেসা কোরি: চিকিৎসা বিদ্যায় নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী
ছবি এডিটঃ সম্পা রানী সরকার

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১৯৪৭ সালে যৌথভাবে যে তিন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার লাব করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন গের্টি কোরি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী তিনিই ছিলেন প্রথম নারী এবং প্রথম আমেরিকানও বটে। মহিয়ষী শত নারীর এ পর্বে আমরা আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানী গের্টি কোরির গল্পই শুনব।

গের্টি তেরেসা রাদনিটজ ১৮৯৬ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমানের চেকপ্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে একটি ইহুদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। সে সময় প্রাগ শহরটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের বোহেমিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গের্টির বাবা অটো রাদনিটজ পেশায় ছিলেন একজন রসায়নবিদ। তিনি চিনি পরিশোধনের একটি সফল পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তাই রিফাইনারি কোম্পানি তাকে তাদের ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। গের্টির মা মার্থাও ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ফ্রানজ কাফ্ফার মতো অনেক নামিদামী কবি সাহিত্যিকের বন্ধুত্ব ছিল তার সাথে।

গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা শেষে গের্টি মেয়েদের লাইসিয়াম স্কুলে ভর্তি হন। চেক প্রজাতন্ত্রের লাইসিয়া স্কুল হল আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুলের চেয়ে কিছুটা উপরে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গের্টি ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত লাইসিয়ামে পড়াশোনা করেন। তার এক চাচা ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ। তার প্রেরণায় গের্টি চিকিৎসা বিদ্যায় উদ্বুদ্ধ হন।

কিন্তু চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশোনা করার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল লেটিন ভাষা, পদার্থ , রাসায়ন ও গণিতে ভাল দক্ষতা। অথচ লাইসিয়ামে গের্টিকে এসব বিষয়ে ভালভাবে শিক্ষা দেয়া হয়নি। এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হতে হলে তাকে কমপক্ষে আট বছরের কোর্স সম্পন্ন করতে হত। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী গের্টি মাত্র এক বছর পড়েই আট বছরের লেটিন ভাষা ও পাঁচ বছরের বিজ্ঞান ও গণিতের কোর্স আয়ত্ব করেন। এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ১৯১৪ সালে কার্ল ফার্ডিন্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে(বর্তমানে চার্লস ইউনিভার্সিটি) ভর্তি হন। এটা ঐ সময়ের নিরিখে কোন নারীর জন্য ব্যতীক্রমী ঘটনা ছিল।

মেডিকেল স্কুলে গের্টির সহপাঠি ছিলেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান যুবক কার্ল কোরি। অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। ১৯২০ সালে ডাক্তারি পাশ করার বছরেই তারা বিয়ে করেন। গের্টি ইহুদি থেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ায় তারা ক্যাথলিক রীতি অনুসারেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা প্রাগ ছেড়ে ভিয়েনায় যান। এখানে গের্টি প্রায় দুই বছর কেরোলিন শিশু হাসপতালে কাজ করেন। তার স্বামী কোরি কাজ করতেন একটি গবেষণাগারে। শিশু হাসপতালে কাজ করাকালীন গের্টি শিশুদের থাইরয়েড চিকিৎসা সংক্রান্তে শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্বণ নিয়ে গবেষণা করে ব্লাড ডিজঅর্ডারের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কার্ল কোরিকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়।

যুদ্ধের পরে তাদের জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। আর্থিক দুরবস্থার সাথে সাথে ইউরোপ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িযে পড়ে। এমন পরিস্থিতে কোরি দম্পতি ইউরোপ ছেড়ে ১৯২২ সালে আমেরিকার উদ্দেশ্যে ইউরোপ ত্যাগ করেন। কার্ল কোরি প্রথমে গিয়ে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেটের ইন্সটিটিউট ফর দি স্টাডি অব ম্যালিগন্যান্ট ডিজেজেস এ গবেষকের কাজ শুরু করেন। এই ইন্সটিটিউটি বর্তমানে রসওয়েল পার্ক ক্যান্সার ইন্সটিটিউট নামে পরিচিত। 

কার্লের ছয় মাস পর গের্টি একই ইন্সটিটিউটে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি গের্টি তার স্বামীর সাথে যৌথভাবে গবেষণার কাজও চালিয়ে যান। এতে বাধ সাধের হাসপাতালের পরিচালক। তিনি গের্টিকে হুমকি দেন, হয় তাকে গবেষণার কাজ ছাড়তে হবে, নইলে হাসপাতাল। কিন্তু গের্টি পরিচালকের হুমকীকে উপেক্ষা করে গবেষণা ও চিকিৎসা দটোই চালিয়ে যান।

কোরি দম্পতির গবেষণার মূলবিষয় ছিল মানব শরীরে কার্বোহাইড্রেট মেটাবলিজম সস্পর্কে। তারা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন, মানব শরীরে হরমোনের সাথে কিভাবে গ্লুকোজ মেটাবোলাইজড বা হজম হয়। রসওয়েল ইন্সটিটিউটে কর্মরত অবস্থায় তারা এ সম্পর্কে ৫০টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। গের্টি কোরি এ সম্পর্কে এককভাবে এগারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৯২৯ সালে কোরি দম্পতি গ্লুকোজ মেটাবলিজম সম্পর্কে একটি চক্র বা সাইকেল প্রস্তাব করেন যা পরবর্তীতে কোরি চক্র নামে প্রসিদ্ধ হয়।

কোরি চক্র বর্ণনা করে মানব শরীরের পেশীতে কিভাবে গ্লাইকোজেনের মতো কার্বোহাইড্রেটগুলো রাসায়ানিক বিক্রয়ার মাধ্যমে ভেঙ্গে ল্যাকটিক অ্যসিডে পরিণত হয় এবং অন্যগুলোকে সংশ্লেষণ করে।

১৯৩১ সালে কার্বোহাইড্রেট বিপাক সংক্রান্ত গবেষণাপত্রসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর কার্ল কোরিকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়। নিউইয়র্কের বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অধ্যাপকের পদ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা কার্লকে চাকরি দিলেও গের্টিকে চাকরি দিতে অস্বীকার করে। এমনকি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় বোর্ডের কর্মকর্তাগণ গের্টিকে জানান, স্বামী-স্ত্রীতে একই কর্মস্থলে কাজ করা আমেরিকার আদর্শ বিরোধী।

অবশেষে তারা মিশৌরি রাজ্যের সেন্ট লুইসে যান। এখানে ওয়াসিনটন ইউনিভার্সিটি কার্ল ও গের্টি উভয়কেই চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। গের্টিকে তার স্বামীর বেতনের এক দশমাংশ বেতনে গবেষণা সহযোগীর পদ নিয়োগ দেয়া হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যানচেলর গের্টিকে একটি বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেন। গের্টিকে তার স্বামীর সমান পদমর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে আরও তের বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে গের্টিকে ওয়াসিনটন বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগী অধ্যাপকে পদোন্নতি প্রদান করেন। আমৃত্যু তিনি সেই পদেই বহাল ছিলেন।

ওয়াসিনটন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনাকালে কোরি দম্পতি গ্লুকোজ ১-ফসফেট আবিষ্কার করেন যাকে পরবতীতে ‘কোরি ইস্টার’ নামে অবিহিত করা হয়। গের্টি কোরি গ্লাইকোজেন সঞ্চয় সংক্রান্ত রোগ নিয়েও গবেষণা করেন। গের্টিই প্রথম প্রমাণ করেন যে এনজাইমের ত্রুটিই মানুষের শরীরে জেনেটিক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

শরীরবৃত্তীয় বিজ্ঞানে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৪৭ সালে গের্টি ও  তার স্বামী কার্ল কোরি  আর্জেনটিনার ফিজিওলোজিস্ট বার্নারডো হৌসের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তবে পুরস্কারের অর্ধেক পান গের্টি ও তার স্বামী  এবং বাকি অর্ধেক পান বার্নারডো।

নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে গের্টি কোরি ছিলেন তৃতীয় নারী বিজ্ঞানী। তার পূর্বে বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত নারীগণ ছিলেন মেরি কুরি ও তার মেয়ে আইরিন কুরি। মজার বিষয় হল, এই তিন নারীই তাদের স্বামীর সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। সে বিবেচনায় কোরি দম্পতি ছিলেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত তৃতীয় দম্পতি।

বিজ্ঞানে অসাধারণ অবদানের জন্য  গার্টিকে ১৯৫৩ সালে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সাইন্স এর ফেলো নির্বাচিত করা হয়। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান তাকে জাতীয় বিজ্ঞান ফাইন্ডেমনের বোর্ড মেম্বারও নিযুক্ত করেন। এছাড়াও গের্টি তার স্বামীর সাথে যৌথভাবে আমেরিকার অনেক জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিন। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা সম্মানার্থে চাঁদ ও শুক্র গ্রহের একটি করে গর্তকে ‘কোরি ক্রেটার’ নামকরণ করেন।

ম্যালিগন্যান্ট ডিজেজ ইন্সটিটিউটে কাজ করার সময় গের্টিকে সারাক্ষণ এক্স-রে ব্যবহার করতে হত। এই এক্স-রে এর প্রভাব শেষ বয়সে তার শরীরের উপর পড়ে। পলে তিনি মজ্জার ক্যান্সারে (মাইলোক্লারেসিস)  আক্রান্ত হন। দীর্ঘ দশ বছর ক্যান্সারে ভুগে ১৯৫৭ সালের ২৬ অক্টোবর এই মহিয়ষী নারী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক নারীদের আদর্শ।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।