বাঙালির শিক্ষা-অশিক্ষা এবং বই পড়ায় দেউলিয়াপনা

আমার আসঙ্কা ও অভিজ্ঞতায় বাঙালিরা এখনও অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মানে কিন্তু নিরক্ষর নয়। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখন পড়তে পারে; লিখতেও পারে। কিন্তু একটি বই পড়ে তার পাঠোদ্ধার করা তাদের অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব নয়। এমনকি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও ‘পা হতে মাথা পর্যন্ত’ বাক্যগুলোকে এক কথায় লিখেন বোরখা। এমনকি, কোন প্রাণী কামড়ালে জলাতঙ্ক রোগ হয়? এ প্রশ্নের উত্তরেও লিখেন, কুমির। এসবই আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। একটি দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষার খাতায় চাকরিপ্রার্থী এমন উত্তরই লিখেছিল। তাই বিএ, এমএ পাশ করা নাগরিকদের জ্ঞানের গভীরতা যদি এই হয়, তবে বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যে খুবই কম সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে বাংলাদেশের মানুষের গড় শিক্ষার হার ৭৪.৬৬%। এ তথ্যে আমাদের মনে গর্ব হতে পারে, বিদেশিদের কাছে নিজেদের মুল্যও বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘ এসডিজির চতুর্থ লক্ষমাত্রার অগ্রগতি নির্ণয়ের জন্য প্রয়োগিক সাক্ষরতার হার নির্ণয়ের জরিপ মতে বাংলাদেশের প্রয়োগিক সাক্ষরতার হার হল মাত্র ৪৩.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের সরকারিভাবে সাক্ষরতার হার নিয়ে যতই মাতামাতি করা হোক দেশের অধিকাংশ মানুষ আসলেই অশিক্ষিত[1]।
বই পড়ার অভ্যাস শিক্ষিত মানুষদেরই কম। কাজের চাপে উচ্চ শিক্ষিতরাও খুব বেশি বই পড়ার সময় পায় না। একটি নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরি প্রার্থীদের এবং চাকরি পাওয়ার পর নূতন অফিসারদের কাছেও আমি জানতে চেয়েছিলাম, তারা গত বছর কয়টি বই পড়েছে। তাদের ৯৯ শতাংশই কোন বই পড়েনি বলে উত্তর দিয়েছিল। এমন কি চাকরিপ্রার্থীরাও মূল বই পড়ে না। নোট আর গাইড পড়ে প্রতিযোগিতার সাঁকোখানা কোন রকম পার হতে চায়। আর একবার একটি চাকরি পেলে পত্রিকাটিও ঠিক মতো পড়ে না।
তবে আমরা বই না পড়লেও অনেক দেশের মানুষ নিয়মিত বই পড়ে। বই পড়ুয়া বলেই তারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই অগ্রগামী। গত বছর (২০২৪ সালের) জরিপ অনুসারে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বই পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। জরিপ মতে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক ১৭টি করে বই পড়েছিল।। এর পরই আছে ভারত (১৬ টি), যুক্তরাজ্য (১৫টি), ফ্রান্স(১৪টি), ইটালি (১৩টি), রাশিয়া (১১টি), অস্ট্রেলিয়া (১০টি), স্পেইন(৯টি), নেদারল্যান্ডস(৮টি) ও সুইজারল্যান্ডের (৬.৭টি) মতো দেশগুলো। প্রকৃতপক্ষে কোন জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির গতিধারা তাদের বই পড়ার অভ্যাস থেকেই বোঝা যায়।
তালিকায় একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যান্য জাতিগুলো স্বভাবতই উন্নত ও কুসংস্কারমুক্ত। অন্যদিকে আমাদের মতো ধর্মাশ্রয়ী জাতিগুলো বই পড়ার কোন তাগিদ অনুভব করে না। ধর্মাশ্রয়ী জাতিগুলো তাদের ধর্মগ্রন্থ ছাড়া অন্য বই পড়ে না। যদি আমরা হিসেব করি, বাঙালি মুসলমানরা বছরে কত ঘন্টা বই পড়ে, তাহলে একটি হিসেবে হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে কেবলই কোরআন কিংবা হাদিসের বইগুলো। ধর্মগ্রন্থ পাঠকারীদের সংখ্যা উন্নত দেশগুলোতেও কম নয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ হল বাইবেল ও দ্বিতীয় গ্রন্থ হল কোরআন। কিন্তু যারা বছরে গড়ে ১৭টি বই পড়ে তারা ধর্মগ্রন্থের বাইরের বই-ই হয়তো ১৬টা পড়েছেন। অন্য বইগুলো বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কিংবা বিনোদনের।
ভারতকে আমরা কোনভাবেই উন্নত দেশের তালিকায় ফেলতে পারি না। একই সাথে ভারতের জাতীয় শিক্ষার হার বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে বেশি নয়( অন্তত সরকারি হিসেবে)। কিন্তু তারপরও ভারতের মানুষের পড়ার অভ্যাস রয়েছে। অন্তত ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর জরিপ তাই বলছে[2]।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের মানুষের চেয়েও শিক্ষিত হওয়ার পরও যে অশিক্ষিত রয়ে যাচ্ছে তার অন্যতম কারণ হল তাদের বই না পড়া। একই সাথে কেবল একটি বই দিনের পর দিন পড়লে মানুষের জ্ঞানও আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের ধর্মান্ধতার মাত্রা বৃদ্ধির পিছনেও একই কারণ রয়েছে। একটি বই, তা যে কোন বিষয়েই হোক না কেন, মানুষ সেটা পড়লে কোন না কোন ভাবে উপকৃত হয়। যুক্তিবোধ বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীকে সে কোন না কোনভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করে।
সাম্প্রতিক আমাদের দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, নাটক, থিয়েটার খেলাধুলা এমনকি বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলোর উপরও ধর্মান্ধরা হামলা করছে। হামলাকারীদের দাবী, কোন গ্রন্থাগারে ধর্ম বিরোধী বা নাস্তিক্যবাদীদের বই রাখতে দেয়া হবে না[3]। বাংলা একাডেমির বাৎসরিক একুশে বই মেলাতেও স্বাধীন চিন্তার বই বিক্রয়ে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়। এমনকি বই প্রকাশের পূর্বে সেগুলোর পাণ্ডুলিপি পুলিশ দিয়ে ভেটিং করানোর মতো প্রস্তাবও উঠেছে[4]। তবে বই প্রকাশের আগে পুলিশকে দিয়ে তার পাণ্ডুলিপি যাচাই প্রক্রিয়া কোন মুক্তি চিন্তার সমাজে কল্পনাও করা যায় না। আর যারা গোটা একটি গ্রন্থাগারের বইকে ধর্মবিরোধী বলে অভিযোগ তুলেছেন,তারা আসলে কোন বইই পড়ে না। আর যদি ধর্ম বিরোধী কথা লিখা থাকেও তবে বই নষ্ট করে তা কি শুদ্ধ করা যাবে? কেউ যদি ধর্মের বিরুদ্ধে বই লিখেন তবে তার বিপরীতে ধর্মানুরাগীদের বই লিখেই তার যুক্তি খণ্ডন করতে হবে। বিবর্তনবাদকে ধর্মন্ধরা এক বাক্যে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ও তাদের বিকাশ হয়ে আজকের মতো বুদ্ধিমান ও প্রযুক্তি ব্যবহারকারী মানুসের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে ধর্মানুরাগীদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করতে হবে। কিন্তু তা না করে, এই তত্ত্বসম্বলিত বই পুড়িয়ে কোন লাভ হবে না।
এমতাবস্থায়, আমাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমি ছোট বেলা থেকেই বই পড়তে ভালবাসি। সপ্তম/অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমাদের স্থানীয় বাজারে অনেক বইয়ের দোকানে বই ভাড়া পাওয়া যেত। ছাত্রজীবন পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের পরেও আমি যে স্থানেই চাকরির সুবাদে বসবাস করেছি, সেখানেই স্থানীয় গ্রন্থাগারগুলোতে গিয়েছি, বই পড়েছি, বই ধার নিয়েছি। কিন্তু চাকরি জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে আমি আগের শহরগুলোর অনেক লাইব্রেরিতে গিয়েছি। আমি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি, এখন ঐসব গ্রন্থাগারে পড়ুয়াদের ভীড় নেই। অনেক লাইব্রেরি বন্ধ হয়েছে। অনেকগুলো ধুকে ধুকে টিকে আছে। এরই মাঝে আবার নূতন উপসর্গ শুরু হয়েছে, লাইব্রেরিতে ধর্মান্ধদের আক্রমণ করা[5]। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষা, ‘ বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’। তাই বাংলা একাডেমির বই মেলায় বাঙালিরা কিছু কিছু বই কেনে। কিন্তু দেউলিয়া হওয়ার ভয়ে হয়তো বই পড়ে না। বিধাতা বাঙালিদের বই পড়ার সুমতি দিন।
রচনাসূত্র:
[1] আজাদ মজুমদার (২০২৩, ৮ সেপ্টেম্বর). বাংলাদেশের সাক্ষরতার হারের পরিসংখ্যান ও ‘মাঠ’ পর্যায়. ডিডাব্লিউ অনলাইন, https://www.dw.com/bn/%E